পর্যটন নগরী কক্সবাজারে নারী পর্যটকদের হেনস্থার কয়েকটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা উঠলে এই ঘটনায় জড়িত যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম (২৩) নামে ওই যুবক সৈকতে ‘বেহায়াপনা’ ঠেকাতে ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়ে নেমেছিলেন।
ফারুকুল নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী হিসাবে চেনাচ্ছিলেন। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসাবেও তার পরিচয় আসছিল।
তবে সমালোচনা ওঠার পর ছাত্রশিবির বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ফারুকুল তাদের সংগঠনের কেউ নন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্থানীয় নেতারাও ফারুকুলের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মটির সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে।
ছাত্র-জনতার যে আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, তার নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে চাপে থাকা জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরও এখন অবাধে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পাচ্ছে।
সরকার পতনের পর অস্থিরতার মধ্যে সম্প্রতি কক্সবাজারের তিনটি ভিভিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফারুকুলের নেতৃত্বে একদল উৎসাহী মানুষ এক নারীকে কান ধরিয়ে ওঠ-বস করাচ্ছে। কাঠের তক্তা হাতে ওই নারীকে হুমকি দিচ্ছেন ফারুকুল।
আরেকটি ভিডিওতেও কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুলকে দেখা যায় দলবল নিয়ে সৈকতে রাতে বিচ চেয়ারে বসা এক নারীকে হেনস্থা করতে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হাতজোড় করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কাছে তার মোবাইল ফোনটি চাইছেন। ওই নারীকে ঘিরে রাখা দলেও ফারুকুল রয়েছেন।
ফারুকুলের ফেইসবুক একাউন্টে দুদিন আগেই এক পোস্টে দেখা যায়, তিনি লিখেছেন- “আজ অফিস টাইম শেষ করে আবার শুরু করবো ,, বেহায়াপনার বিরুদ্ধে ,, ইনশাআল্লাহ।”
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর আরেক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, “কক্সবাজারে বাজার গাড়া, লালদীঘির পাড়, কলাতলী যত সব নারী বেহায়াপনায় লিপ্ত আছেন ৯ তারিখ সন্ধ্যা ৬টায় অভিযান চালাবো ইনশাআল্লাহ, আওয়াজ তুলুন।”
শুক্রবার এই ভিডিওগুলো দেখার পর ব্যাপক সমালোচনা উঠলে ফারুকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকেসহ ছয়জনকে আসামি করে শনিবার দুপুরে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেন হেনস্থার শিকার এক নারী।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মছিউর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আটক যুবককে আদালতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
শুক্রবার রাতে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে ফারুকুলকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক জাবেদ মাহমুদ জানান।
ফারুকুল কক্সবাজার শহরের ওই এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার চুনতি এলাকায়।
ফারুকুলের ফেইসবুক একাউন্টে তথ্য দেওয়া আছে, তিনি চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন।
শিবির ও বৈষম্যবিরোধীদের অস্বীকার
ফারুকুলের ভিডিও নিয়ে আলোচনার মধ্যে কক্সবাজার জোনের ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, ভিডিও তিনটি তিনি দেখেছেন। এরপর খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছেন যে ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে কিছু শিক্ষার্থী সৈকতে ভ্রমণে আসেন গত ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে। তারা তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজনকে মারধর করে তাড়িয়ে দেন।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ কক্সবাজার সফরের ভিডিও-ও নিজের ফেইসবুকে তোলেন ফারুকুল।
ফারুকুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ কি না- জানতে চাইলে কক্সবাজারের স্থানীয় সমন্বয়ক শাহেদুল ইসলাম শাহেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আটক যুবক জেলার সমন্বয়ক বা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ নন।
“আন্দোলনে যেহেতু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নানা শ্রেণী-পেশা, মত ও পথের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল; আটক যুবকেরও অংশগ্রহণ থাকতে পারে। তাই বলে তিনি সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না।”
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কেউ স্ব-উদ্যোগে কিছু করলে তার দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেবে না বলেও জানিয়ে দেন শাহেদুল।
ফারুকুলের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সোশাল মিডিয়ায় তার ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আসে। ফারুকুলের ফেইসবুকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভা সংক্রান্ত নানা পোস্ট ধরেই অনেকে বলেন, এই যুবক শিবিরে যুক্ত।
ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচির খবরও ফারুকুল দিয়ে আসছিলেন ফেইসবুকে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর তিনি এক পোস্টে লিখেছিলেন- “আলহামদুলিল্লাহ, আগামীকাল ইনশাআল্লাহ, দীর্ঘ ১৬ বছর পর মুক্তভাবে সমাবেশ হবে। সাথী সম্মেলন। আয়োজনে: বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর।”
সেই সভার ভিডিও দিয়ে ওই দিনই তিনি আরেক পোস্টে লিখেছিলেন- “শিবির, শিবির, ধ্বনিতে প্রকম্পিত …. আজ বীর চট্টলার শিবির কর্মীরা। বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবির, চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ।”
ফারুকুলকে নিয়ে সমালোচনা ওঠার পর শনিবার ইসলামী ছাত্রশিবির এক বিবৃতিতে কক্সবাজারের ঘটনাকে ন্যক্করজনক আখ্যায়িত করে বলেছে, এই যুবকের পোস্ট ঘিরে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “এ ন্যক্কারজনক কাজে ফারুকুল ইসলাম নামের এক যুবককে বিশেষভাবে সক্রিয় দেখা গেছে এবং তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
“যদিও ফারুকুল ইসলাম সরাসরি নিজেকে ছাত্রশিবির বলে পরিচয় না দিলেও তার ফেসবুক ওয়ালে কিছু পোস্ট শেয়ারের কারণে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যে, সে ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িত। এই বিভ্রান্তির ফলে ছাত্রশিবিরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।”
ফারুকুলের সঙ্গে শিবিরের কোনও সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো যাচ্ছে যে, ফারুকুল ইসলাম বা তার এই ধরনের আচরণের সাথে ছাত্রশিবিরের দূরতম কোনও সম্পর্কও নেই। ফারুকুল ইসলামের আচরণ ছাত্রশিবিরের আদর্শ ও নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
“আমরা নারীদের সম্মানহানিকর যেকোনও কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
সৈকতে নারী হেনস্থা করার ঘটনায় কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল মালিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এমন ঘটনা দেশের পর্যটন শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম শিকদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভিডিওতে আমি দেখলাম মেয়েটা কাঁদছে, পর্যটন সংস্কৃতির আলোকে এটা কাম্য নয়। মানুষ যখন পর্যটনের উদ্দেশ্যে আসে, তখন তারা রিল্যাক্সে থাকতে পছন্দ করে। সেটাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো একেবারেই কাম্য নয়।
“এ ধরনের ঘটনা আমরা কক্সবাজারে আগে কখনও দেখিনি। এটা পর্যটন শিল্পের জন্য শুভ সংকেত বলা যায় না। পর্যটকদের জন্য শতভাগ নিরাপদ পরিবেশ থাকতে হবে।”