সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ বাংলাদেশি নাবিক ঈদের আগে মুক্তি পাবে কি না—তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হতে পারে ১১ এপ্রিল, ফলে হাতে সময় আছে ১৪ দিন। এই সময়ের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে সমঝোতা, টাকা পৌঁছানো ও নাবিকদের দেশে ফেরত আনা- অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। এরপর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যায় দস্যুরা।
এরও ৮ দিন পর ২০ মার্চ দস্যুদের পক্ষ থেকে জাহাজ মালিক কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাবিকদের পরিবারে কিছুটা উৎকণ্ঠা কমে।
স্বজনরা এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নাবিকদের মুক্তির জন্য। স্বজনদের আশা, ঈদের আগেই মুক্তি পাক নাবিকরা।
জাহাজ মালিকপক্ষ থেকে আলোচনার কথা বলা হলেও মুক্তিপণ নিয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। দস্যুপক্ষ থেকেও মুক্তিপণ কত চাওয়া হয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি।
তবে মুক্তিপণের টাকার অঙ্ক নিয়ে শুরু হয় দর কষাকষি। যদিও গত ২০ মার্চ থেকে আট দিনেও এর সমঝোতা হয়নি। অর্থাৎ জাহাজ মালিক ও সোমালি দস্যু দুই পক্ষই সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। ফলে নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় দেশে ফেরা দীর্ঘায়িত হয়।
যদিও আগের পরিস্থিতির চেয়ে এই সময়কে দীর্ঘায়িত বলতে রাজি নন জাহাজ মালিকপক্ষ।
২০১০ সালে ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় সোমালি দস্যুদের হাতে জিম্মি হয় একই মালিকের আরেক জাহাজ ‘জাহান মণি’। তখন জিম্মি অবস্থা থেকে বাংলাদেশি নাবিকদের ছাড়িয়ে আনতে ১০০ দিন লেগে গিয়েছিল। সেই তুলনায় এখন তো মাত্র ১৬ দিন।
ঈদের আগে নাবিকদের মুক্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ।
প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলছেন, “অক্ষত অবস্থায় নাবিকদের দেশে ফেরানোই জাহাজ মালিকের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে সেই সময় কখন সেটি বলা সম্ভব নয়। তবে আগের জাহাজের মুক্তিপণের অভিজ্ঞতায় আমরা এবার বেশ এগিয়ে আছি।”
জিম্মি আবদুল্লাহ জাহাজটি এখন সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড প্রদেশের নুগাল অঞ্চলের জিফল উপকূলের দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙ্গর করে আছে।
মূলত চার দফা স্থান পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ জাহাজটিকে একেবারে নিজেদের কব্জায় নিয়ে রেখেছে দস্যুরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপারেশন আটলান্টা এবং ভারতীয় নৌ বাহিনীর পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জাহাজে থাকা নাবিকদের উদ্ধারের পরিকল্পনা নিলেও বাংলাদেশ সরকার এবং জাহাজ মালিক কবির গ্রুপের পক্ষ থেকে সাড়া না মেলেনি।
এতে বেশ চাপে পড়ে সোমালি দস্যুরা। ফলে মুক্তিপণ-সমঝোতার মাধ্যমেই নাবিকদের ছাড়িয়ে আনার কৌশলে আগায় জাহাজ মালিক ও সোমালি দস্যুরা।
দুই কারণে এবার নাবিকদের দ্রুত ফেরানাে সম্ভব বলছেন মেরিনাররা। একটি হচ্ছে, দস্যুদের চতুর্মুখী চাপে থাকা; দ্বিতীয়ত, মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনার আগের অভিজ্ঞতা।
মাস্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলছেন, “২০১০ এবং ২০২৪ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০১০ সালে সোমালি দস্যুদের রমরমা অবস্থা ছিল। একটার পর একটা জাহাজ জিম্মি করছিল আর মুক্তিপণ আদায় করছিল। এখন তো সেই পরিস্থিতি নেই, দস্যুরা এখন ব্যাকফুটে!”
“এখন দস্যুদের হাতে জাহাজ হাতে গোনা তিনটি। তারপর আবদুল্লাহ জাহাজ ঘিরে নিরাপদ দূরত্বে টহল দিচ্ছে ইউরোপিয়ান এবং ভারতীয় নৌ বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ। স্থলভাগে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে উপকূলের পান্টল্যান্ড পুলিশ। আকাশপথে চক্কর দিচ্ছে ভারতীয় নৌ বাহিনীর বিমান। ফলে সবদিক থেকে চাপের মুখে আছে দস্যুরা। এখন দস্যুরা দ্রুত যোগাযোগ করেই বিষয়টির সমাধান চাইবে।”
ক্যাপ্টেন আনাম বলছেন, “ঠিক কতদিন লাগতে পারে-এমন বিষয় অফিসিয়ালি বলা খুব কঠিন। তবে মুক্তিপণের টাকার অংকে সমঝোতা হলেই নাবিকদের ছাড় পেতে দেরি হবে না। এখন নিশ্চয়ই দুপক্ষে দর কষাকষি চলছে।
“আগে আমরা দেখেছি সোমালিয়া থেকে তারা যেকােনোভাবে পাশের দেশ ওমান পৌঁছালে ওমানের মাস্কাট বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ঢাকা বা চট্টগ্রাম ফ্লাইটে দেশে পৌঁছতে পারবেন। টাকার সমঝোতা হলে ঈদের আগেও দেশে ফেরাতে দেরি হবে না।”
জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ। শনিবার নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইফতার আয়োজন করে নাবিকদের দ্রুত ফেরাতে স্বজনদের আশ্বস্ত করেন জাহাজ মালিকপক্ষ।
এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের ছোট ভাই আসিফ খান বলেন, “জাহাজের মালিকপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছে। দস্যুরা কীভাবে সাড়া দিচ্ছে সেটি জেনে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ এগোবে। সকলেই প্রত্যাশা করে রোজার ঈদের আগেই স্বজনরা পরিবারের কাছে ফিরবে। কিন্তু এর জন্য সময় লাগতে পারে এবং ধৈর্য্য ধরতে হবে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন অগ্রগতি আছে
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কব্জায় থাকা জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ এবং এর ২৩ নাবিককে উদ্ধারে অগ্রগতি হওয়ার তথ্য দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “জাহাজ সম্পর্কে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, নাবিকদেরকে মুক্ত করার আলাপ-আলোচনার মধ্যে আমরা আছি।
“আমরা নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছি এবং আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা এবং একইসাথে জাহাজটাকে উদ্ধার করা। আমরা অনেকদূর এগিয়েছি, শুধু এটুকু বলতে চাই।”