Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

‘হুমায়ূন স্যার বলতেন, গুণ নিয়ে জন্মালে প্রকৃতিই তা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেয়’

‘হুমায়ূন স্যার বলতেন, গুণ নিয়ে জন্মালে প্রকৃতিই তা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেয়’
[publishpress_authors_box]

ফজলুল কবীর তুহিন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। টেলিভিশনেও দীর্ঘদিন নাটক ও অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। নির্মাতারা ক্যামেরার পেছনে থাকেন বলে তাদের খুব একটা চেনেন না দর্শকেরা। তবে তুহিনকে তারা চেনেন। যদিও এই চেনা অনেকাংশেই নির্মাতা হিসেবে নয়, অভিনেতা হিসেবে।

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘আজ রবিবার’- এর সেই হলুদ পাঞ্জাবি পরা হিমুর বেশে ‘ছোট চাচা’ চরিত্রটির কথা মনে আছে? কিংবা ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রের সেই বন্দি মুক্তিযোদ্ধাকে- যার আঙুল কেটে নেয় নৃশংস পাকিস্তানি মিলিটারি? নিশ্চয়ই চোখে ভাসছে দৃশ্যগুলো।

ফজলুল কবীর তুহিন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের এক প্রিয় সহচর। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের গানের সাথে হুমায়ূনের পরিচয় তিনিই ঘটিয়েছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তার সাথে আলাপন, কিছু স্মৃতিচারণ।

চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য হুমায়ূন আহমেদ ‘আজ চিত্রার বিয়ে’ উপন্যাসটি আপনাকে দিয়েছিলেন। গল্পটা জানতে চাই..

ফজলুল কবীর তুহিন: এটা ২০০৮ সালের কথা। আমি তখন লন্ডনে থাকি। সে বছর আমি দেশে আসলে স্যারের সাথে দেখা করি। এটা ছিল উনার সাথে প্রায় দশ বছর পর দেখা হওয়া- মাঝে অনেকদিন দেখা নেই। দখিন হাওয়ার বাসায় তার সাথে বসে কথা বলছি। কথার প্রসঙ্গে তখন ওনাকে বললাম, স্যার আমার খুব ইচ্ছা আপনার একটা গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবো। ইতোমধ্যে স্যার জানেন যে আমি সিনেমা নিয়ে কিছু কাজ করছি বা পড়াশোনা করছি। স্যার বললেন, ‘কোন উপন্যাসটা করতে চাও?’ আমি বললাম, ‘আজ চিত্রার বিয়ে’।

স্যার বললেন, ‘তুমি এই গল্পটা কেন করতে চাচ্ছো? আরও তো অনেক ভালো গল্প আছে।’ আমি বললাম, ‘স্যার আমার মনে হচ্ছে এটা সিনেমার জন্য খুব ভালো একটা গল্প।’ তখন তিনি অন্য একটি বই এর নাম প্রস্তাব করে বললেন, ‘তুমি এটা ইংল্যান্ডেও করতে পারো’। আমি বললাম, ‘না স্যার আমি বাংলাদেশেই সিনেমা বানাতে চাই’। কিন্তু উনি কিছুতেই কনভিন্সড না যে, ‘আজ চিত্রার বিয়ে’ ভালো সিনেমা হতে পারে। তখন আমি ওনাকে বললাম, স্যার আমি আপনার অনুমতি ছাড়াই কিছু কাজ করেছি সিনেমাটা নিয়ে। আমি কি আপনাকে দেখাবো? চিত্রনাট্যের কিছু অংশ আমার করা আছে।’ তিনি বললেন, হ্যাঁ, দেখাও।

চিত্রনাট্য দেখে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ ভালোই তো মনে হচ্ছে। বলো আমি কি করতে পারি?’ আমি বললাম, স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আমি সিনেমার কাজটা শুরু করতে পারি। তখন তিনি বললেন, কী দলিলপত্র করতে হবে?’ আমি সম্মতি জানালাম। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি কাগজ পত্র নিয়ে আসো, আমি কপিরাইট দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।’ আমি দু’দিন পর কাগজপত্র নিয়ে গেলাম। তিনি তেমন কিছু না পড়েই সই করে দিলেন। শাওন (মেহের আফরোজ শাওন) এটার সাক্ষী ছিলেন।

কবে আমরা দেখতে পাবো ‘আজ চিত্রার বিয়ে?’

ফজলুল কবীর তুহিন: চলচ্চিত্রটির চিত্রানাট্য পুরোপুরি প্রস্তুত। লোকেশন এবং কাস্টিংও দেখে রেখেছিলাম। এর মধ্যে তো উনি অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। ছবিটা নিয়ে তখন আর এগুনো হয়নি। এরপর আমি আরও দুটি ছবি নির্মাণে হাত দেই। দুটি ছবিই সরকারের অনুদান পায় এর মধ্যে যেটির নির্মাণ সমাপ্ত সেটি ‘বিলডাকিনি’। অন্যটি ‘গাঙকুমারী’, এটির নির্মাণ পুরোপুরি শেষ হয়নি এখনও। আশা করছি আগামী বছরের মাঝামাঝিতে আজ চিত্রার বিয়ে নির্মাণে হাত দিতে পারবো।

হুমায়ূন আহমেদের সাথে আপনার সম্পর্কের শুরু ও এর রসায়নটা জানতে চাই

ফজলুল কবীর তুহিন: স্যারের সাথে আমার পরিচয়ের শুরুটা ছিল ১৯৯৩ সাল থেকে। আমি তার চরম ভক্ত ছিলাম। তার উপন্যাস নাটক গোগ্রাসে পড়ে ফেলি বা দেখে ফেলি। ১৯৯২ সাল থেকেই আমরা সুনামগঞ্জে ‘হাসন উৎসব’ নামে পাঁচদিনব্যাপী বেশ বড়সড় একটা উৎসব করতাম। দ্বিতীয় উৎসবেই প্রধান অতিথি হিসেবে আমি হুমায়ূন স্যারের নাম প্রস্তাব করলাম। কেননা, তিনি তখন তার নির্মাণে আমাদের সুনামগঞ্জের ফোক গান ব্যবহার করতেন- হাসন রাজা, দূরবীন শাহ। তো, আমি আর সংগীতশিল্পী সেলিম চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন স্যারের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাই। তিনি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান। আমি স্যারকে নিয়ে সুনামগঞ্জ যাই। তারপর থেকেই স্যারের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতাম। স্যার নিয়ে যেতেন, আমাকে দিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়াতে, যদিও আমি শিল্পী না। সেভাবেই স্যারের সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়ে যায়।

‘আজ রবিবার’ নাটকের সেই হিমু চাচা ফজলুল কবীর তুহিন এখন যেমন।

হুমায়ূন আহমেদের মাধ্যমে আপনি শাহ আবদুল করিমের গান সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?

ফজলুল কবীর তুহিন: ওই যে বলছিলাম হাসন উৎসব- এর কথা। সে রাতে অনুষ্ঠান শেষ করে স্যারকে নিয়ে যখন আমরা সার্কিট হাউজে ফিরি, তখন তিনি বললেন, ‘তুহিন চলো না আমরা কিছু শিল্পী নিয়ে আমরা আড্ডা দেই, ঘরোয়া একটা প্রোগ্রাম করি, একটু গান শুনি’। তখন আমি কিছু শিল্পীদেরকে বলি সার্কিট হাউজে আসার জন্য। স্যার তো এমনিতেই একটু ঘরোয়া পরিবেশে গান শুনতে পছন্দ করতেন। নিজের মতো করে আড্ডার মধ্যে গান। সেখানে অনেকেই গান গাচ্ছিলেন। তখন কেউ একজন বললেন, আমাকে একটা গান গাওয়ার জন্য। তখন আমি ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটা গাই। এ গানটা গাওয়ার পর স্যার জিগেস করলেন, এ গানটা কার?

আমি বললাম, এটা আমাদের অঞ্চলের সাধক, শাহ আবদুল করিমের গান। ওনার সম্পর্কে স্যারের খুব একটা জানা ছিল না। তখন আশেপাশের অনেকেই তাকে কিছু তথ্য দেন। এর মধ্যে আরও দু’একজন শাহ আব্দুল করিমের কয়েকটা গান তাকে শোনায়। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি এক কাজ করো, উনাকে নিয়ে আসো।’

উনি ভেবেছিলেন, করিম হয়তো শহরেই বা আশেপাশেই থাকেন। আমি বললাম, তিনি তো অনেক দূরে থাকেন। সেখানে যেতে যেতেই সকাল হয়ে যাবে। তখন তিনি প্রস্তাব করলেন, উনাকে কি একবার ঢাকায় আনা যাবে? আমি উনাকে নিয়ে কিছু গান করতে চাই। গানগুলো আসলে আমাদের এত ভালো লাগলো। উনার গানগুলো যদি আমাদের ভালো ভালো সিঙ্গাররা গায় তাহলে তিনি অনেক পপুলার হবেন। করিম তখন আমাদের সুনামগঞ্জেই খুব পপুলার ছিলেন। আমাদের মেইনস্ট্রিমে তার গান খুব একটা পরিচিত ছিল না।

হুমায়ূনের অসীম আগ্রহে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর শাহ আব্দুল করিমকে ঢাকায় আনা সম্ভব হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আবুল খায়ের।

আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর শাহ আব্দুল করিমের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম, তাকে বলতাম চলেন ঢাকায় যাই। কিন্তু নানা অসুখ-বিসুখে ভুগতেন তিনি। প্রচারবিমুখ মানুষও ছিলেন। এ মাসটা না, পরে যাই, এ সপ্তাহে না পরের সপ্তাহে যাই- এরকম করতেন। এরকম করতে করতে প্রায় একবছর আমি উনার পিছনে লেগেই ছিলাম। তারপর একসময় শাহ আব্দুল করিমকে আমি ঢাকায় নিতে সমর্থ হই। স্যারের তখন বাসা ছিল ধানমন্ডিতে। সে বাসায় টেলিভিশনের জন্য আমরা একটা সাক্ষাৎকার নেই। গান বিষয়ে শাহ আব্দুল করিমের সাক্ষাৎকারটি নেন পরম শ্রদ্ধেয় অভিনেতা আবুল খায়ের। তার সাক্ষাৎকারটিকে মাঝে রেখে তার পাঁচটি গান বিটিভিতে প্রচার হয়।

এর মধ্যে আমি গেয়েছিলাম- আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, সুবীর নন্দী গেয়েছিলেন আমি কুল হারা কলঙ্কিনী, আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা, সেলিম চৌধুরী গেয়েছিলেন এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা, বেবী নাজনিন গেয়েছিলেন তোমরা কুঞ্জ সাজাওগো।

গানগুলো টেলিভিশনে প্রচারের পর বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেটিই ছিল শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান। এরপর অনেকেই তার গানের চর্চা ও ব্যবহার শুরু করেন।

হুমায়ূন স্যার বলতেন, গুণ নিয়ে জন্মালে প্রকৃতিই তা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেয়। শাহ আবদুল করিমের ক্ষেত্রেও তা হয়েছিল। স্যার এরপরে হাওর অঞ্চলের, ভাটি অঞ্চলের অনেক গান তার সৃষ্টির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মানুষের মাঝে।

একজন নির্মাতা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের নির্মাণকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ফজলুল কবীর তুহিন: একজন ক্ষুদ্র নির্মাতা হিসেবে তাকে নিয়ে বলাটা আমার মানায় না। তবু বলবো, তিনি তার লেখার মধ্য দিয়ে যতোটা সমাদৃত ছিলেন, নির্মাতা হিসেবেও তিনি নিঃসন্দেহে কিছু ভালো কাজ করে গেছেন। আমি নিজেও কাজ করেছি তার সঙ্গে ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রে। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘আগুনের পরশমনি’ অন্যতম। এটি এখনও মানুষ উপভোগ করে-অবশ্যই এটি কালজয়ী চলচ্চিত্র। একইভাবে শ্রাবণ মেঘের দিনে, চন্দ্রকথাসহ যেটিই নির্মাণ করেছেন একটি অনন্য স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন।

‘আগুনের পরশমনি’-চলচ্চিত্রের সেই বন্দী মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে তুহিন। চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যে তার আঙুল কেটে নেয় নৃশংস পাকিস্তানি মিলিটারি।
ফজলুল কবীর তুহিন পরিচালিত ‘বিলডাকিনি’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে মোশাররফ করিম এবং পার্নোমিত্র।

আপনার নির্মিত ‘বিলডাকিনি’-চলচ্চিত্রটি মুক্তির অপেক্ষায়। কোন পর্যায়ে আছে সেটি?

ফজলুল কবীর তুহিন: আমার নির্মিত ‘বিলডাকিনি’ চলচ্চিত্রটির সব কাজই শেষ। সেন্সরও হয়ে গেছে। মোশাররফ করিম ও পার্নো মিত্র -এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। গত পাঁচই অক্টোবর ছবিটির মুক্তির তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বরের দিকে মুক্তির পরিকল্পনা করছি নতুন করে।

ফজলুল কবীর তুহিনের ‘গাঙকুমারী’ চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্য।

আর ‘গাঙকুমারী’ চলচ্চিত্রটি?

গাঙকুমারী’র সত্তর ভাগ শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরে হয়তো শুটিং শেষ করে জানুয়ারিতে পোস্ট এডিটিং এর কাজ শেষ করে ফেলতে পারবো। এ ছবিতেও মোশাররফ করিম অভিনয় করেছেন। একটি নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করছেন। তারই বেশকিছু কাজ বাকি আছে। আশা করি তার সাথে সময় মিলিয়ে নিয়ে ছবিটির কাজ শেষ করতে পারবো।

আপনার জন্য শুভকামনা

ফজলুল কবীর তুহিন: সকাল সন্ধ্যাকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত