বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে পুরুষদের মতো নারীদের এবং নির্দিষ্টভাবে নারী শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা সবাই দেখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ছাত্র ও গণআন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ শুধু আন্দোলনের দিক পরিবর্তন করেনি, বরং আন্দোলনের পরে কমিউনিটি সেবায়ও বড় প্রভাব ফেলেছে। রাস্তা পরিষ্কার থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত, এই তরুণী শিক্ষার্থীরা সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তাদের অঙ্গীকার দেখিয়েছেন এবং বহু তৃণমূল উদ্যোগের প্রধান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারীদের সামনে আসা
ইতিহাসের আলোকে, বাংলাদেশে অনেক ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলন দেখা গেছে, যেখানে পুরুষ শিক্ষার্থীরা প্রায়শই অগ্রভাগে ছিল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে, যেখানে নারী শিক্ষার্থীরা এই প্রতিবাদ-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের অংশগ্রহণ শুধু আন্দোলনে নতুন উদ্যম যোগ করেনি, বরং এটি সক্রিয়তার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি সামনে নিয়ে এসেছে।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যা একটি দ্রুতগতির বাসে দুই ছাত্র নিহত হওয়ার পর শুরু হয়েছিল, সেখানে আমরা স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের সামনে আসতে দেখেছি। ২০১৮ সালেই এর কিছুদিন পর চাকরির কোটা সংষ্কারের আন্দোলনেও নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। আর এবারকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা মূলত কোটা সংস্কারের দাবিতেই শুরু হয়েছিল, নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা পায়। প্ল্যাকার্ড হাতে এবং কণ্ঠ উঁচু করে, তারা শুধু অংশগ্রহণকারী ছিল না; তারা সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্লোগান দিয়েছেন এবং তাদের উদ্দীপনা ও সংকল্পের সাথে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
নারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই স্লোগানে নেতৃত্ব দিত, মিছিলে সামনের সারিতে দাঁড়াত, এবং সমাবেশ সংগঠিত করত। তাদের উপস্থিতি দুটি প্রভাব ফেলেছিল: এটি তাদের ছাত্র-সাথীদের সাহস যুগিয়েছিল এবং অদ্ভুতভাবে, পুলিশ ও শাসক দলের সহযোগীদের দ্বারা শারীরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা স্তর প্রদান করেছিল। লক্ষ্য করা দরকার যে এটা করতে গিয়ে এবারের আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী মারাত্মক হামলা-মারধর-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অনেকেই মনে করেন নারী শিক্ষার্থীরা সামনের দিকে না থাকলে আমাদের আরও অনেক আন্দোলনকারী ছাত্রকে হারাতে হতো।
সমাজের লিঙ্গীয় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা ও অন্তর্ভুক্তি উৎসাহিত করা
এই আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বাংলাদেশের সমাজে ঐতিহ্যগত লিঙ্গীয় ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে নারীরা সমাজে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালনকারী হিসেবে বিবেচিত। সংগ্রামী স্লোগান দিয়ে, মঞ্চে উঠে এসে, এই তরুণীরা শুধু তাদের অধিকার দাবি করেনি বরং বাংলাদেশি সমাজে একজন নারী হওয়ার অর্থ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাদের নির্ভীক সক্রিয়তা অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে, আন্দোলনগুলোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করেছে এবং জনগণের বৈচিত্র্য প্রতিফলিত করেছে।
তাদের নেতৃত্ব অন্যান্য অবহেলিত গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে। বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং জাতিগত গোষ্ঠী থেকে নারীদের অন্তর্ভুক্তি আন্দোলনে গভীরতা যোগ করেছে, বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের পারস্পরিক সংযোগ প্রদর্শন করেছে। এই বৃহত্তর কণ্ঠস্বরের জোট প্রতিবাদকে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর করেছে, কারণ তারা জনগণের বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করে সমাজে প্রোথিত পুরাতন বিবিধ সমস্যার সমাধান করেছে। নারী শিক্ষার্থী ছাড়াও আন্দোলনে বিভিন্ন পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নারী কর্মীদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। তাছাড়া বাসায় অবস্থান করেও অনেক নারী তাদের সন্তানদের অন্যায্য-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন। আন্দোলন ও পরবর্তী সেবা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক আন্দোলনকারীদের অনেক মা-বোনকেও দেখা গেছে। স্কুল পড়ুয়া ছোট ছোট মেয়েদের দেখা গেছে মিছিল করতে, যেমন চট্টগ্রাম ডিওএইচএস।
আন্দোলন পরবর্তী সেবায় নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা
নারী শিক্ষার্থীদের প্রভাব প্রতিবাদগুলোর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়নি। সফল আন্দোলন শেষে, নারী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন পরবর্তী সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কমিউনিটিতে দৃশ্যমানভাবে অবদান রেখেছে। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সড়ক পরিষ্কার এবং ট্রাফিক পরিচালনার কাজ, যা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়, কিন্তু বৃহৎ পরিসরের এটা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সুরক্ষা ও স্বাভাবিকতা রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাতেও তাদের অংশগ্রহণ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৫ আগস্টের পর গণরোষের কারণে থানা ও সড়ক থেকে বেশ কিছুদিন পুলিশের অনুপস্থিতিতে, ছাত্রছাত্রীরা ট্রাফিক পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য জরুরি যানবাহনের মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করে। এই ধরনের দায়িত্ব এবং নাগরিক কর্তব্য তাদের সহযাত্রীদের কল্যাণের প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে, কমিউনিটিতে তাদের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা আরও শক্তিশালী করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শিক্ষার্থীকে সড়ক থেকে ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গিয়েছিল, যাতে জীবন যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। তাদের প্রচেষ্টা শুধু প্রতীকী নয়; সড়ক পরিষ্কার করে, এই শিক্ষার্থীরা একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে: তাদের সংগ্রাম শুধু পুরনো বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ভাঙার জন্যই নয় বরং একটি নতুন, আরও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ নির্মাণের জন্যও।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা
এই নারী শিক্ষার্থীদের কর্ম সমাজে বিস্তৃত প্রভাব রেখেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তরুণীদের তাদের নিজস্ব কমিউনিটিতে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের নির্ভীক প্রতিবাদে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তী কমিউনিটি সেবায় নিবেদিত ভূমিকা দেখিয়েছে যে নারীরা ঘর-বাহির সকল ক্ষেত্রে সমান পারদর্শী। তাদের প্রয়োজন সর্বত্র এবং তারা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ভালোভাবেই প্রস্তুত।
চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি গ্রহণ
নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও, তারা আন্দোলন, প্রতিবাদ ও কমিউনিটি সেবায় অংশগ্রহণের সময় অনেক চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হন। শারীরিক সহিংসতা, হয়রানি এবং এমনকি নির্যাতনের হুমকি অন্যতম। সামাজিক কারণে পারিবারিক চাপও থাকে। তাছাড়া, বাংলাদেশি সমাজের পিতৃতান্ত্রিক প্রকৃতিতে, নারী আন্দোলনকারীদের প্রায়শই বেশি পরিশ্রম করতে হয়, যাতে তারা গুরুত্ব পায়। তারা প্রায়ই এমন সমালোচনা এবং পর্যালোচনার সম্মুখীন হয় যা পুরুষদের মুখোমুখি হতে হয় না। তবুও, এইসব বাধা সত্ত্বেও, এই নারী শিক্ষার্থীরা ন্যায় ও সমতার জন্য সংগ্রামে আপসহীন থেকে অবিচলিতভাবে সামনে এগিয়ে যাবে।
নারীদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিতে সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা
ডিজিটাল যুগে, সামাজিক মিডিয়া নারী শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বরকে বাড়ানোর এবং তাদের গল্প বিশ্বব্যাপী শোনানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফেইসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্মগুলো প্রতিবাদ সংগঠিত করার, সচেতনতা ছড়ানোর এবং আন্দোলনের জন্য সমর্থন সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নারী শিক্ষার্থীরা এসব প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করতে, তাদের জোরালো বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং তাদের আন্দোলনের সপক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে।
সামাজিক মিডিয়া অনলাইন সম্প্রদায় গঠনের সুযোগও প্রদান করেছে যেখানে নারী আন্দোলনকারীরা একে অপরের সাথে সংযোগ করতে পেরেছে এবং একে অপরকে সমর্থন দিয়েছে। সামাজিক মিডিয়ার বৈশ্বিক পরিসর বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সহায়ক হয়েছে; আন্দোলন আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কসমূহ আন্দোলনের গতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যখন আন্দোলন সম্পন্ন ও সফল হয়েছে তখন থেকে অদ্যাবধি। বিভিন্ন মিডিয়া হাউসে কর্মরত নারীরা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
আগামীর লিঙ্গ-বৈষম্যহীন সমাজের অঙ্গীকার
বাংলাদেশের সমাজে এই নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং কমিউনিটি সেবায় কেবল দৃশ্যমান নয় বরং ভীষণ তাৎপর্যময়। তারা শুধু আন্দোলনের নেতৃত্ব দেননি, বরং কমিউনিটি সেবায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে একটি টেকসই পরিবর্তনের পথ তৈরির জন্য কাজ করছেন। তাদের ত্যাগ, উদ্যম, এবং প্রত্যয়ের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের অগ্রভাগে নিজেদের ঠাঁই করে নিয়েছেন। এই নারীদের সংগ্রাম ও সাফল্য শুধু তাদের ব্যক্তিগত অর্জন নয়; এটি বৃহত্তর সমাজের জন্য একটি প্রেরণা।
এবারের আন্দোলনে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সঠিক প্রেরণা এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে, নারীরা সামাজিক পরিবর্তনে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সক্ষমতা রাখেন। তাদের অবদান ভবিষ্যতের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে, যা বাংলাদেশে ন্যায়বিচার এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত থাকবে এবং আগামী বাংলাদেশে একটা লিঙ্গ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে গতিশীল করবে।
সমাজে ন্যায্যতা ও সাম্যের লড়াইয়ে নারীদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতির মাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে গৎবাঁধা নেতিবাচক ধারণার অবসান ঘটুক, সমাজের সর্বত্র তাদের নিরাপদ অবস্থান ও চলাফেরা স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, তারা যদি সম্মান ও মর্যাদার সাথে পুরুষদের মতো সমাজে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখার নিরাপদ সুযোগ পান তাহলে দেশের অগ্রগতি সুনিশ্চিত।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]