পাটুরিয়ায় ডুবে যাওয়া ফেরি এমভি রজনীগন্ধা মাত্র এক দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির ফেরিবহরে যুক্ত হয়েছিল।
বুধবার দুর্ঘটনার পর বলা হচ্ছে, ফেরিটি পুরনো হয়ে পড়েছিল। তবে বিআইডব্লিউটিসি বলছে, ফেরিটি পুরনো তো ছিলই না, এর কোনো ত্রুটিও আগে দেখা দেয়নি।
ফেরিটি দুর্ঘটনায় পড়ার কারণ নিয়েও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বালুবাহী একটি বাল্কহেডের ধাক্কায় ডুবেছে ফেরিটি। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুজন বলছেন, ফেরিটি তলা ফেটে ডুবেছে। ঘাটে থাকা বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মচারীও তাদের কথায় সমর্থন দিয়েছেন।
রজনীগন্ধা কেন ডুবল, তার অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় তিন বছর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে ডুবে গিয়েছিল আরেকটি ফেরি, যার নাম আমানত শাহ।
তখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তাদের প্রতিবেদনে বিআইডব্লিউটিসির মেরিন বিভাগের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, আমানত শাহর ফিটনেস ছিল না। তলদেশে একাধিক ফুটো নিয়েই করছিল গাড়ি পারাপার।
সেই তদন্ত কমিটি বিভিন্ন নদীবন্দরে ঘটে যাওয়া পাঁচটি ফেরি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ করেছিল। কমিটির সদস্যরা আমানত শাহসহ ১০টি ফেরি পরিদর্শনও করে।
তাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিআইডব্লিউটিসির ৫৩টি ফেরির মধ্যে ৫০টির কোনো ফিটনেস সনদ নেই। এছাড়া ২৯টি ফেরিতে নেই কোনো রাডার ব্যবস্থা, চারটিতে রাডার থাকলেও সেগুলো নষ্ট।
ফেরিগুলোর ১২টিতে পানির গভীরতা পরিমাপ করার যন্ত্র ‘ইকো-সাউন্ডার’ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি। সাতটিতে যন্ত্র থাকলেও তা ছিল নষ্ট।
এবার ডুবে যাওয়া রজনীগন্ধার তেমন কোনো সমস্যা ছিল না বলে দাবি করেছেন বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম মিশা।
রো রো টাইপ আদলের রজনীগন্ধা ফেরিটি বিআইডব্লিউটিসির ডকইয়ার্ডে তৈরি হয়েছিল।
নজরুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০১৪ সালের জুন মাসে এই রজনীগন্ধা যাত্রা শুরু করে। ফেরিটি ৮ থেকে ১১টি বড় যান ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।”
রজনীগন্ধা মধ্যরাতের পর দৌলতদিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে পাটুরিয়া আসছিল। তবে কুয়াশার কারণে চলতে না পারায় এটি পাটুরিয়ার কাছে পদ্মা নদীতে নোঙর করেছিল। তখন ফেরিটিতে নয়টি ছোট-বড় ট্রাক ছিল।
ফেরিতে থাকা ট্রাক মালিক কুষ্টিয়ার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, “ভোর ৪টার দিকে ফেরির তলা দিয়ে পানি ওঠা শুরু করে। সকালের দিকে ফেরি ডুবতে শুরু করে। কোনও বাল্কহেড ধাক্কা দেয়নি।”
ফরিদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমানকে উদ্ধৃত করেও সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, তলা ফেটে ফেরিটি ডুবে যায়। কারণ ফেরিটি অনেক পুরনো এবং ওভারলোড ছিল।
পাটুরিয়া ঘাটে কর্মরত আইডব্লিউটিসির কর্মচারী খালিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নিচের দিক থেকে পানি উঠে ডুবে গেছে (ফেরিটি)। মাঝরাত থেকে পানি উঠতে উঠতে সকালে ডুবছে।”
তবে নজরুল বলেন, “এটির (রজনীগন্ধা) ফিটনেস নিয়ে কোনো ইস্যু ছিল না। ২০০৯ সালের থেকে আমরা যে ফেরিগুলো সংগ্রহ করেছি, সেগুলোকে আমরা নতুন ফেরি বলে বিবেচনা করি।”
বিআইডিব্লিউটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, এক একটি ফেরির আয়ুষ্কাল ২৫ বছর। তবে পুনর্বাসন করা হলে আয়ুষ্কাল আরও ১১ বছর পর্যন্ত বেড়ে যায়।
নজরুল বলেন, “আশির দশকে ডেনমার্ক থেকে আমরা কিছু ফেরি সংগ্রহ করেছিলাম, সেগুলো আবার ধরেন ৪০ বছর ধরে একই সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। ডেনমার্ক থেকে আমরা রো রো টাইপ ফেরিই বেশি নিয়েছিলাম।”
বিআইডব্লিউটিসির বহরে মূলত দুই ধরনের ফেরি রয়েছে, রো রো ফেরি ও ডাম্প ফেরি। ইঞ্জিনসহ রো রো ফেরিগুলো বড়। কিছু ছোট রো রো ফেরি বা কে টাইপ ফেরিও রয়েছে। ডাম্প ফেরিগুলো মূলত টাগবোট দিয়ে টেনে নেওয়া হয়।
বিআইডব্লিউটিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তারা সর্বমোট ১৭টি ফেরি সংগ্রহ করে। এরমধ্যে কোনো ফেরির বয়সই ২৩ বছরের বেশি নয়। এর কয়েকটি সংযোজিত হয় ২০১৫ সালের জুনে।
২০১০ সালে অপরাজিতা ও দোলনচাঁপা নামে দুটি ইউটিলিটি টাইপ ফেরি সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ এর জুলাইয়ে কিষাণী ও কাবেরী নামে কে টাইপ এবং একই বছরের আগস্টে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন নামে রো রো ফেরি সংগ্রহ করে।
২০১৪ সালে সাতটি ফেরি যোগ হয় বহরে। সেগুলো হলো- মাধবীলতা, বনলতা, কৃষ্ণচূড়া, হাসনা হেনা, শাপলা, শালুক ও চন্দ্রমল্লিকা।
২০১৫ সালে রজনীগন্ধা ছাড়াও ক্যামেলিয়া, কুসুমকলি ও ভাষাসৈনিক গোলাম মাওলা নামে তিনটি কে টাইপ ফেরি এবং একটি রো রো ফেরি বহরে যুক্ত করে বিআইডব্লিউটিএ।
নজরুল জানান, দেশের আটটি ফেরি রুটের মধ্যে ছয়টি এখন চালু রয়েছে, যেখানে সবমিলিয়ে তাদের ৫২টি ফেরি চলছে।
পাটুরিয়া দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজিরহাট, ভোলা-লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর-শরীয়তপুর, লাহারহাট-ভেদুরিয়া রুট সচল রয়েছে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি এই দুটি রুট বন্ধ রয়েছে।