Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

ফিফা নিষিদ্ধ কমলাপুর টার্ফে শঙ্কার ফুটবল

কমলাপুর-টার্ফ-৪-960x540-20012024
[publishpress_authors_box]

বাফুফে এলিট একাডেমির নতুন কোচ পিটার বাটলার বুধবার এসেছেন বাংলাদেশে। ঢাকায় পৌঁছে বৃহস্পতিবার থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এই ব্রিটিশ ফুটবল কোচ।

বিকেলে তিনি যখন কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ঢুকছিলেন, সেখানকার কৃত্রিম টার্ফের নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো ছিল পাশের নির্মানাধীন ভবন থেকে ছিটকে পড়া ইট, পাথরের টুকরো।    

বাটলার এক পাশে ফুটবলারদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন, অন্য পাশে স্টেডিয়ামের পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরিস্কার করছিলেন ইটের টুকরো।

আগামী ২ ফেব্রুয়ারি এই স্টেডিয়ামে শুরু হবে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ।

ফিফার বিধিনিষেধ

অথচ কমলাপুরের এই টার্ফে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের অনুমতি দিচ্ছে না ফিফা। এ কারণে মেয়েদের ফিফা ফ্রেন্ডলি নিয়ে মাহফুজা আক্তার কিরণকে অন্য ভেন্যু খুঁজতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাফুফে মহিলা ফুটবলের চেয়ারম্যান বলেছেন, “ঢাকায় ফিফা ফ্রেন্ডলি খেলবো আমরা। তবে মনে হয়, কমলাপুরে আমরা খেলতো পারবো না। কমলাপুরের টার্ফের অবস্থাও ভাল নয়, ফিফাও অনুমতি দেবে না। সেক্ষেত্রে হয়তো বসুন্ধরা কিংসের মাঠে আয়োজনের চেষ্টা করবো। ওখানে প্রচুর দর্শকও হয়, তাই ওই মাঠেই খেলাতে পারি।” সুতরাং বাফুফে খুব ভাল করে জানে, এই টার্ফ খেলা হওয়ার উপযোগী নয়। এরপরও ফুটবলারদের গুরুতর ইনজুরির শঙ্কাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা খেলিয়ে যাচ্ছে এই মাঠে।     

বর্তমানে টার্ফের যেমন অবস্থা

ফিফার ‘গোল প্রকল্প’-এর অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে কমলাপুরে বসানো হয় কৃত্রিম এই টার্ফ। কিন্তু স্থাপনের দেড় বছরের মধ্যেই এটির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কৃত্রিম ঘাসের নিচে কালো রঙের দানাযুক্ত যে রাবারের উপাদানগুলো থাকে, সেগুলো ঘাসের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল আগেই। ফলে সবুজ রঙের কৃত্রিম ঘাসগুলো আর দেখা যায় না। তখন টার্ফের কিছু অংশ আসল রং হারিয়ে ফেলে। টার্ফের স্বাভাবিক রংটা তাই এখন আর দেখা যায় না।

সাধারণত ফিফা অনুমোদিত টার্ফে ইনফিল নামে কিছু রাবারের দানা থাকে। কমলাপুরের টার্ফে এই দানা কম। ফলে খেলোয়াড়ের পায়ে টান পড়ে। বলের বাউন্স অসমান হয়। ইনফিল কমে যাওয়ায় কৃত্রিম ঘাসও কিছুটা দেবে গেছে অনেক জায়গায়। টার্ফের মান এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও নানা সময়ে উঠেছে প্রশ্ন এবং সমালোচনা হয়েছে। ঠিকমতো যত্ন না নেওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় রুক্ষ হয়ে গেছে কৃত্রিম ঘাস। যেখানে খেলে অনেক খেলোয়াড় আঘাত পেয়েছেন। এমনকি বল নিয়ন্ত্রণ করতেও হিমশিম খেতে হয় খেলোয়াড়দের।

বিশ্রাম নেই টার্ফের

টার্ফটি স্থাপন হওয়ার পর থেকে বাফুফের অন্ধের যষ্ঠি হয়ে ওঠে। পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগসহ এই মাঠে প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও  নিচের দিকের সব খেলাই অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সন্ধ্যা মিলিয়ে দিনে সর্বোচ্চ পাঁচটি ম্যাচ হওয়ারও নজির আছে কমলাপুর স্টেডিয়ামে। এছাড়া বাফুফের এলিট একাডেমির অনুশীলন, নারী ফুটবলারদের বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলের অনুশীলন এমনকি স্থানীয় পাড়ার খেলাগুলোও চলে। তাছাড়া এসব অনুশীলনের ফাঁকেই স্থানীয় বাসিন্দারা বৈকালিক ফুটবল বিনোদনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এই টার্ফে।

একটি টার্ফ দৈনিক যেখানে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা ব্যবহৃত হওয়ার কথা, সেখানে কমলাপুরের টার্ফ দৈনিক ব্যবহৃত হয় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা! স্বাভাবিক ভাবেই জীবনী শক্তি হারিয়েছে এই টার্ফ। কমলাপুর স্টেডিয়ামের সদ্য বিদায়ী প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমার চাকরি জীবনে এমন ঘটনা কখনোই দেখিনি। এতগুলো ম্যাচ এক দিনে চললে কি আর টার্ফ টিকতে পারে বেশি দিন?”

টার্ফ যেন চোটের ফাঁদ

খেলতে নামলেই চোট। কমলাপুরের টার্ফ ফুটবলারদের জন্য রীতিমতো আতঙ্ক! মানহীন এই টার্ফে খেলতে গিয়ে চোটে পড়েছেন তপু বর্মণ। দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে ছিলেন জাতীয় দলের এই ডিফেন্ডার। এখানে খেলে বিভিন্ন সময়ে চোটে পড়েছেন রাফায়েল অগাস্তো, জাফর ইকবাল, ফার্নান্দেজ, তারেক কাজী, রিয়াদুল রাফির মতো তারকা ফুটবলার। এই টার্ফে খেলা বয়কট করে বসুন্ধরা কিংস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও উত্তর বারিধারা। প্রতিবাদ জানিয়ে ২০২১ সালে তারা অংশ নেয়নি ফেডারেশন কাপে।

টার্ফ নিয়ে বিদেশিদেরও অভিযোগ

ঘরোয়া ফুটবলাররা তো টার্ফ নিয়ে নিয়মিত অভিযোগ করেই আসছেন। সেই তালিকায় বিভিন্ন সময়ে যোগ দিয়েছে বিদেশিরাও। গত বছর অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে আসা নেপাল ও ভুটানের কোচেরাও অভিযোগ করেন। ওই টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে চোটে পড়েন নেপালের চার জন ও ভুটানের দুজন ফুটবলার।

নেপালের কোচ ইয়াম প্রাসাদ গুরং তখন বলেছিলেন, “এখানকার টার্ফটা অনেক শক্ত। এখানে খেললে হ্যামস্ট্রিং চোট, মাংসপেশিতে টান ও হাঁটুর চোটের সম্ভাবনা বেশি।’ভুটানের কোচ কারমা দেমা বলেছিলেন, “আমাদের টার্ফের সঙ্গে তুলনা করলে এখানকার টার্ফ খুবই বাজে।”

২০২২ সালে মালয়েশিয়া নারী দলের কোচ জ্যাকম জোসেফ ফিফা প্রীতি ম্যাচ খেলতে এসেও টার্ফ নিয়ে অভিযোগ করেন।

গোড়াতেই ছিল গলদ

বাফুফের গ্রাউন্ডস ও ফ্যাসালিটিজ কমিটির প্রধান ফজলুর রহমান বাবুলের দাবি, “এই টার্ফ যখন বসানো হয়েছে তখন থেকেই সমস্যার শুরু। টার্ফ বসানোর আগে ছোট ছোট পাথরের টুকরো দিতে হয়। সেটিই ঠিকমতো হয়নি। ফিফার অর্থায়নে ভারতীয় যে প্রতিষ্ঠান টার্ফটি বসায়, তারাও ভালোভাবে স্থাপন করেননি এটি। টার্ফ যখন বানানো হয় তখন এটা মান সম্পন্ন ছিল না। তখনই আমি আপত্তি করেছিলাম। সেটি বুঝে নেওয়ার সময়ও আমার কোনো সই নেই। আসলে ফিফার প্রচুর পরিমাণ টাকা এখানে অপচয় হয়েছে “

 এই মাঠে খেলা চালানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ তিনি, “ওই মাঠের বিষয়ে বাফুফে থেকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করেও না। আমিও জানতে চাই না। আসলে খেলার অনুপযুক্ত জায়গা এটা। ফিফা এখানে খেলতে নিষেধ করেছে। কিন্তু সাফে তাদের খবরদারি নেই। মাঝে মধ্যে টিমগুলো আপত্তি জানায়। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ। আমি কোনো কথাও বলি না। আমাকে জিজ্ঞাসাও করেনা। জানতেও চায় না এ ব্যাপারে। আমার পরামর্শ নেওয়ার জন্য যদি না ডাকে, কতটুকু যেচে করতে পারি?”

ফুটবলারদের শঙ্কার কথা ভেবে তিনি যোগ করেন, “এখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ চালানো উচিত না। কারণ এখানে খেললে ফুটবলারদের ব্রঙ্কাটাইটিস হবে, পাথর নাকে মুখে ঢুকতে পারে। স্লাইডিং করতে গেলে লিগামেন্ট ছিড়ে যেতে পারে। অনেক সমস্যা। “  

অসহায় সাফ 

সাফের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল অসহায়ের সুরে বলছিলেন, “আমি নিজেও মনে করি যে এমন মাঠে খেলা চালানো ঠিক না। এই মাঠ খেলা চালানোর অবস্থায় নেই। কিন্তু কি করবো? আসলে মাঠই তো নেই।”

চাইলেও অন্য জায়গায় হবে না টুর্নামেন্ট বলে জানিয়েছেন তিনি, “ অন্য জায়গায় যে ভেন্যু নিয়ে যাব, সেই স্বাগতিকও কেউ হতে চায় না। আমাদের অনেকটা বাধ্য হয়ে টুর্নামেন্ট নিতে হয়েছে এখানে। তাছাড়া এই টুর্নামেন্ট আমরা পেছাতেও পারিনা। কারণ এটা পেছাতে গেলে এএফসির টুর্নামেন্ট এসে পড়বে।”

কোচদেরও আপত্তি

গত দুই আসরে নারী ফুটবল লিগে অংশ নিয়েছে রংপুরের সদ্য পুষ্করিনী দলের কোচ মিলন মিয়া। তিনি আপত্তি জানিয়ে  বলেন, “এই মাঠ খারাপ। আমার ফুটবলার চোটে পড়েছে এখানে খেলে। পেনাল্টি স্পট যেমন থাকার কথা তেমন নেই। টার্ফটা খেলে তৃণমূলের মেয়েরা অভ্যস্ত না। তাছাড়া দুপুরে বেশিরভাগ ম্যাচ হয়। তখন তাপমাত্রা বেশি থাকে রোদের। ওই সময় টার্ফ গরম হয়ে যায়। মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাদের চাওয়া অন্য মাঠে খেলা।”

বর্তমানে এই টার্ফ সংস্কার সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। অবশ্য বাফুফের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান মানিক বৃহস্পতিবার জানালেন, “সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই টার্ফ সংস্কারের অনুমোদন পেয়ে যাবো আমরা।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত