Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ফিফা ‘দ্য বেস্ট’র ভোট ও বাস্তবতা

২০২৩ সালের ‘দ্য বেস্ট’র জন্য ১২ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিল ফিফা। ছবি: ফিফা ডটকম
২০২৩ সালের ‘দ্য বেস্ট’র জন্য ১২ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিল ফিফা। ছবি: ফিফা ডটকম
Picture of খালিদ রাজ

খালিদ রাজ

‘যোগ্যতা যাচাই করার জন্যেও যোগ্যতা প্রয়োজন।’- প্রবাদটা এবারের ফিফা ‘দ্য বেস্ট’ ফুটবলারের নাম ঘোষণার পর খুব খাটে! তেমন কোনও পারফর্ম না করেও ফিফার পুরস্কার জিতেছেন লিওনেল মেসি। অন্যদিকে গোলের মালা গেঁথে, সাফল্যে লুটাপুটি খেয়েও দ্বিতীয় হতে হয়েছে আর্লিং হলান্ডকে। প্রশ্ন তাই জোরেশোরে উঠছে, ফিফা কি সেরা খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজটা সঠিকভাবে করতে জানে? তাদের ভোটিং প্রক্রিয়াটাই-বা কতটুকু যৌক্তিক?

ভোটের ইতিহাস

১৯৯১ সালে চালু হয় ফিফার অ্যাওয়ার্ড। তখন নাম ছিল ‘ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়’। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই নামেই ছিল। তবে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যালন ডি’অরের সঙ্গে মিলে পুরস্কারটি দেওয়া হয় “ফিফা-ব্যালন ডি’অর” নামে। এরপর ২০১৬ সাল থেকে হয়ে আসছে ‘দ্য বেস্ট’।

‘দ্য বেস্ট’ নামে নতুন করে অ্যাওয়ার্ড শুরুর পর পরিষ্কারভাবেই সব নিয়মকানুন জানিয়েছিল ফিফা। জাতীয় দলের অধিনায়ক, জাতীয় দলের কোচ, ফিফার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে থেকে একজন করে সাংবাদিক ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুটবল ভক্ত- এই চার গ্রুপে ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারণ করা হয় বর্ষসেরা ফুটবলার। নিয়মে স্বচ্ছতা থাকার পরও মেসির পুরস্কার প্রাপ্তিতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

অথচ জটিলতা ও সন্দেহ না রাখতে প্রতি বছরই ‘দ্য বেস্ট’ অ্যাওয়ার্ড শেষে ভোটের তালিকা প্রকাশ করে ফিফা। কে কাকে ভোট দিয়েছেন, কোন নম্বরে রেখেছেন, সব বিস্তারিত থাকে ওই তালিকায়। তারপরও জটিলতা কাটে না। কারণটা হয়তো ভোট গণনা করার নিয়ম সবার ঠিকঠাক জানা থাকে না বলে। ফিফাও একেকবার একেক নিয়ম চালু করে জটিল করে তুলেছে ভোট গণনার প্রক্রিয়া।

২০১৬ সালে চালু হওয়া ‘দ্য বেস্ট’-এ বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচনে ভোট গণনা করা হতো শতাংশ হিসাবে। এই হিসাবে যার ভোটের শতাংশ বেশি থাকতো তিনি জিততেন বর্ষসেরার পুরস্কার। কিন্তু তিন বছর যেতেই ২০১৮ সাল থেকে শতাংশের হিসাব-নিকাশ থেকে বেরিয়ে আসে। ২০১৯ সাল থেকে বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচন করা হচ্ছে ভোটিং পয়েন্ট হিসাব করে।

শুরুর প্রক্রিয়া

২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যালন ডি’অরের সঙ্গে মিলে ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার দিয়েছিল ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। চুক্তি শেষে ২০১৬ সাল থেকে ‘দ্য বেস্ট’ দিয়ে আসছে ফিফা। সহজ ভাষায় ‘বর্ষসেরা’ খেলোয়াড়, কোচ, গোলকিপার, গোল বেছে নেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে।

বর্ষসেরা খেলোয়াড় বাছাইয়ের প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হয় ফিফার ফুটবল বিশেষজ্ঞদের প্যানেলের মাধ্যমে। একটা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পারফরম্যান্স ও সাফল্যের বিবেচনায় এই কমিটি ঠিক করে দেয় সংক্ষিপ্ত তালিকা। এবার ওই সময়টা ধরা হয়েছে ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ের পারফরম্যান্স ও সাফল্য আমলে নিয়ে ফিফা ১৪ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছিল ১২ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা।

যেভাবে হয় ভোট গণনা

সেরা পুরুষ ও নারী খেলোয়াড়- দুই ক্যাটাগরিতেই বর্ষসেরা ফুটবলার বেছে নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় থাকে ভোটিং সিস্টেম। চার গ্রুপে ভাগ হয়ে ভোটাররা তাদের সেরা খেলোয়াড় বেছে নিতে পারেন। চারটি গ্রুপে থাকেন- জাতীয় দলের কোচ, জাতীয় দলের অধিনায়ক, সাংবাদিক ও ফুটবল ভক্ত।

একজন ভোটার সর্বোচ্চ তিনজনকে ভোট দিতে পারেন। পছন্দ অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়- এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের রায় জানিয়েছেন। এখানে প্রথম পছন্দের খেলোয়াড়ের জন্য বরাদ্দ ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পছন্দের খেলোয়াড়ের জন্য ২ পয়েন্ট ও তৃতীয় বা শেষ পছন্দের জন্য ১ পয়েন্ট।

এই চার গ্রুপের অর্থাৎ কোচ, অধিনায়ক, সাংবাদিক ও ভক্তদের ভোটের পয়েন্টকে আবার স্কোরিং পয়েন্টে রূপান্তর করা হয়। স্কোরিং পয়েন্টে যিনি এগিয়ে থাকেন তিনিই জেতেন ‘দ্য বেস্ট’। স্কোরিং পয়েন্ট ব্যাপারটা হলো, কোনও গ্রুপে ভোটিং পয়েন্টে যিনি সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাবেন তার স্কোরিং পয়েন্ট ধরা হবে ১৩।

ধরুন, কোচদের ভোটে কোনও একজন সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়েছেন। সুবাদে তার স্কোরিং পয়েন্ট হবে সর্বোচ্চ ১৩। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্টধারীর স্কোরিং পয়েন্ট হবে ১১। তৃতীয় জন পাবেন ৯ স্কোরিং পয়েন্ট। এভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ ফুটবলারের স্কোরিং পয়েন্ট দাঁড়াবে ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩, ২ ও ১। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ১১ জনের বেশি ফুটবলারও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে একাদশের পরের খেলোয়াড়দের স্কোরিং পয়েন্ট হবে ০ (শূন্য)। প্রত্যেকের স্কোরিং পয়েন্ট যোগ করেই সেরা ফুটবলার বাছাই করা হয়। সর্বোচ্চ পয়েন্ট যার, তিনিই জেতেন ফিফা ‘দ্য বেস্ট’।

কীভাবে হয়েছে এবারের হিসাব  

কোচদের রায়ে হলান্ড পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৫৪১ পয়েন্ট, দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেসির সংগ্রহ ৪৭৬ পয়েন্ট। সুতরাং দুজনের স্কোরিং পয়েন্ট যথাক্রমে ১৩ ও ১১। একইভাবে সাংবাদিকদের ভোটিং পয়েন্টে আগুয়ান ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকারের স্কোরিং পয়েন্ট ১৩, তার পরে থাকা আর্জেন্টাইন তারকা পেয়েছেন ১১ স্কোরিং পয়েন্ট। কিন্তু অধিনায়কদের ভোটিং পয়েন্টে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন এগিয়ে থাকায় এই গ্রুপে তার স্কোরিং পয়েন্ট ১৩। এই গ্রুপে দ্বিতীয় স্থানে থেকে হলান্ড পেয়েছেন ১১ স্কোরিং পয়েন্ট। একই চিত্র ভক্তদের ভোটের বেলায়ও। তাই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর স্কোরিং পয়েন্ট (১৩+১৩+১১+১১) যোগ করলে হয় একই, ৪৮।

অর্থাৎ জয়-পরাজয়ের নিয়ামক এই স্কোরিং পয়েন্টে মেসি ও হলান্ড একই জায়গায়। এখন ‘দ্য বেস্ট’ পুরস্কার দিতে হলে টাই ব্রেক করতে হবে। ফিফা তখন এই পুরস্কারের ধারা-১২ প্রয়োগ করেছে। যে ধারায় বলা আছে, ভোটিং পয়েন্ট সমান হলে ‘টাইব্রেক’ করতে দেখা হবে জাতীয় দলের অধিনায়কদের ভোট। অধিনায়কদের রায়ে যিনি প্রথম পছন্দ, তার হাতে উঠবে ‘দ্য বেস্ট’। এই নিয়মে অধিনায়কদের প্রথম পছন্দের তালিকায় বেশি ছিলেন মেসি, তাই তিনিই জিতেছেন ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার।

তারপরও আছে প্রশ্ন

নিজের পছন্দের খেলোয়াড়কে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। এ নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে। কারণ অনেকে মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে ভোটের অঙ্কটা মেলাতে পারছেন না। ফিফার বেঁধে দেওয়া সময়ে (১৯ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ২০ আগস্ট ২০২৩) ফুটবলারদের পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করলে কোনোভাবেই মেসি সেরা হন না। ওই সময়ের পারফরম্যান্সের বিচারে হলান্ড অনেক এগিয়ে থাকেন।

এই সময়ে রীতিমতো ফুটবল দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন নরওয়ের এ স্ট্রাইকার। রীতিমতো গোলের বন্যা বইয়ে দিয়ে ম্যান সিটিকে উপহার দিয়েছেন ঐতিহাসিক ট্রেবল। প্রিমিয়ার লিগে গড়েছেন এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ মৌসুমে ৫৩ ম্যাচে তার ৫২ গোল।

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স কিংবা দলীয় সাফল্যে হলান্ডের ধারেকাছেও নেই মেসি। আর্জেন্টাইন তারকা এই সময়ে জিতেছেন কেবল লিগ ওয়ানের শিরোপা। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথা ধরলে পিএসজির লিগ ওয়ান জয়ের পথে মৌসুমের সর্বোচ্চ ১৬ অ্যাসিস্ট ছিল তার। গোলও ১৬টি।

আর সব বাদ দিন। মেসি নিজেও হয়তো পুরস্কারটি পেয়ে বিশ্বাস করতে পারেননি। হলান্ডের পারফরম্যান্সে সঙ্গে তুলনায় দাঁড় করালে তার অর্জন ছিল সামান্য। সেকারণেই কিনা লন্ডনে আয়োজিত ফিফার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না তিনি! তাছাড়া তার কাছেও তো সেরা হলান্ড। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে তার দেওয়া ভোটে ‘প্রথম পছন্দ’ কিন্তু এই নরওয়েজিয়ান তারকাই!

মেসির দ্য বেস্ট জয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ, হতাশ। তাদেরই একজন লোথার ম্যাথেয়াস। জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মেসির ভীষণ ভক্ত। কিন্তু এবারের পুরস্কারটি কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি, “এবার পুরস্কারটি সে (মেসি) জিততে পারে না। আমার কাছে সে গত ২০ বছরের সেরা ফুটবলার। প্যারিসে ও মায়ামিতে সে আলোড়ন তৈরি করেছে, কিন্তু বড় কোনও শিরোপা জিততে পারেনি।”

ম্যাথেয়াসের এই কথাই যেন অনেকের কথা। তাই ফিফার ভোট গণনা নিখুঁত হলেও জনতার অঙ্কের সঙ্গে তা মিলছে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত