রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের প্রতিটি সেক্টরেই পরিবর্তন ও সংস্কারের দাবি উঠছে। সে যাত্রায় থেমে নেই দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন নির্মাতারাও। নতুন দিনের স্বপ্নে আশায় বুক বেঁধেছেন তারাও। তাই সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করার আগে নিজেদের মধ্যে সকল বিভেদ ও সিন্ডিকেট দূর করে কী করে চলচ্চিত্রের সামগ্রিক উন্নয়নে ‘চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ- ২৪’ উত্থাপিত হবে তা নিয়েই আলোচনায় মশগুল হয়েছেন তারা।
এসব আলোচনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে দাবি বিষয়ক প্রস্তাবনার কাজ এগিয়ে চলছে।
শুক্রবার নিকেতনের গ্রাউন্ড জিরোতে অনুষ্ঠিত হয় নির্মাতাদের দ্বিতীয় বৈঠকটি। প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বিএফডিসিতে। প্রথম বৈঠকে উত্থাপিত ২৪টি দাবির প্রেক্ষিতেই এগিয়ে চলেছে আলোচনা।
তবে, মোটাদাগে কিছু বিষয়ের উপর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই মতামত রাখছেন সবাই। নির্মাতাদের মতে, চলচ্চিত্র শিল্পকে ঘিরে নানা অন্যায়,অন্যায্যতা আর সিন্ডিকেট এত গভীরভাবে হয়ে এসেছে যে, চলচ্চিত্র বিষয়ক বিদ্যমান সকল সিস্টেমকে বাতিল করে নতুন একটি পথে হাঁটতে চান তারা।
সে যাত্রায় তাদের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-
ক. স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত চলচ্চিত্র কমিশন গঠন, স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত চলচ্চিত্র কাউন্সিল গঠন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীদের নিয়ে দ্য স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড- আমেরিকান ফেডারেশন অভ টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিও আর্টিস্ট (SAG – AFTRA/IATSE) এর আদলে এবং জাতীয় ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগাইনেশনের শ্রম আইনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে একটি ফেডারেল ইউনিয়ন গঠন।
খ. বিদ্যমান বাকস্বাধীনতা পরিপন্থী সকল নিপীড়ণমূলক আইন বাতিল, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো সংস্কার, বিসিটিআই ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগগুলোকে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
গ. মাধ্যমিক শিক্ষার সিলেবাসে চলচ্চিত্র সন্নিবেশ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র উৎসব করা এবং ফিল্ম সেন্টার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
গ্রাউন্ড জিরোতে এ প্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছিলেন নির্মাতা মিশুক মনি।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে বলা যায়, সিনেমা রিলিজের আগে আমরা কিছু সংগঠন থেকে প্রবলেম ফেইস করি, সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের সোসাইটি শুটিং ফ্রেন্ডলি না সে জায়গায় কিছু প্রবলেম ফেস করতে হয়, সে প্রবলেমগুলো উতরে যখন সেন্সরশিপে যাই তখন আমাদের গলা চিপে ধরাটাও সহজ হয়ে গিয়েছে।”
এসেছিলেন চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে জুরি হিসেবে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনা সাদিয়া খালিদ রীতি।
তিনি বলেন, “বিগত সরকারের দমনমূলক যেসব নীতিগুলো ছিল, সেগুলো বাতিল করা, চলচ্চিত্রের যে পুরস্কার তা কাকে দিব, কাকে দিব না- সেইসব জায়গায় প্রশ্ন আছে, সেসব ভেঙে জবাবদিহিতা আছে এমন একটি জায়গায় যদি পৌঁছানো যায় তার চেষ্টা করা হবে।”
নির্মাতা খিজির হায়াত খান বলেন, “এতদিন ধরে আলোচনাবিহীনভাবে ইন্ডাস্ট্রিটা চলেছে- ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে, আলোচনা আরও অনেক বেশি হওয়া দরকার। যতো বেশি আলোচনা হবে, ততবেশি আপনি গভীরে যেতে পারবেন, আলোচনাবিহীনভাবে হুট করে আমরা কিছু চাইলাম, হুট করে আমরা কাছে যাবো, কার কাছে যাবো না, কে কতটুকু পেলাম, কে পেলাম না, সেটা যেন না হয়, আমার মনে হয় এমন আলোচনা অনেক বেশি হওয়া দরকার। আলোচনায় আমাদের ঠিক করা হচ্ছে কোন কোন জিনিসগুলো আমাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে দরকার। এমন তো আর না যে সবকিছু আমরা ঠিক করে ফেলতে পারবো, এ জন্যই ঠিক করা দরকার কোন জিনিসগুলো ঠিক করলে তা আমাদের সামনে এগিয়ে চলার পথকে সহজ করে দিবে।”
বিকেল ৪টা থেকে শুরু করে এ আলোচনা চলে রাত আটটা অব্দি। ‘ব্যক্তির উর্ধ্বে গিয়ে সমষ্টি স্বার্থই হবে মূল কথা’-এমন মন্ত্রই ধ্বনিত হয়েছে সকলের কণ্ঠে। আলোচনায় মূল স্বর ছিলো তারুণ্যের। ঢাকায় বসে আলাপ হলেও এ আয়োজনে অনলাইনে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জেলা এবং দেশের বাইরে থেকেও নির্মাতা ও শিক্ষানবিশ নির্মাতারা যুক্ত হয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আরও কয়েকটি বৈঠক পরে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে- ‘চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ ’২৪।