৩৯ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘোরা হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রের হয়রানির অবসান হয়েছে। মিথ্যা মামলা দায়ের করায় তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। আগামী তিন মাসের মধ্যে মামলার বাদী সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এ অর্থ দিতে হবে।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের আপিল আবেদন খারিজ করে সোমবার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এ রায় দেয়।
রায়ের পর হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রের আইনজীবী ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ মামলা লড়তে গিয়ে ৪০ বছর ধরে হরেন্দ্রনাথ আদালতের বারান্দায়। ৪০ বছর ধরে তার বেদনার কথা মাননীয় আপিল বিভাগ শুনেছেন, আদালত মর্মাহত হয়েছেন।”
এই আইনজীবী বলেন, “হরেন্দ্রকে অহেতুক মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করে তার জীবনের ৪০টি বছর কেড়ে নেওয়ার কারণে ২০ লক্ষ টাকা সোনালী ব্যাংককে মামলার খরচ বাবদ ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। তিন মাসের ভেতর এই ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।”
গত ১৯ নভেম্বর ‘৩৯ বছর গেল, হরেন্দ্রনাথের আদালতে ঘোরার শেষ হবে কবে’ শিরোনামে সকাল সন্ধ্যা’য় একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সেই প্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা হরেন্দ্রনাথের চাকরি চলে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মামলার ফাঁদে পড়ে জীবন নাভিঃশ্বাসের করুণ গল্প ওঠে আসে।
মামলা বিত্তান্ত
৭৯ বছর বয়সী বৃদ্ধ হরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ৩৯ বছর আগে তিনটি মামলা হয়েছিল, দুটিতে আগেই খালাস পান তিনি। কিন্তু একটি ঝুলে থাকায় তার আদালতের বারান্দায় ঘোরাই শেষ হচ্ছিল না।
হরেন্দ্রনাথ এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। তহবিল তছরুপের অভিযোগে ৩৯ বছর আগে চাকরি হারান তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়।
দুটি মামলা থেকে খালাস পেলেও ব্যাংকের করা বাকি একটি মামলায় তিনি নিম্ন আদালত এবং হাই কোর্টে খালাস পেলেও আপিল বিভাগে তা ঝুলে যায়।
ব্যাংকের চাকরি হারিয়ে এক সময় বাস কাউন্টারে টিকেট বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন হরেন্দ্রনাথ। তাতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় হতে হয় তাকে। দুই মেয়েকেও বিয়ে দিতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু মামলার পেছনে ভিটেমাটিসহ সব খরচের পর আর কোনও উপায় ছিল না তার।
কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ বিএ পাস করে ১৯৭৯ সালে সোনালী ব্যাংকে ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে যোগ দেন। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক হন। এর পর তাকে ব্যাংকের ঢাকার যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়।
যাত্রাবাড়ী শাখায় থাকা অবস্থায় ১৯৮৫ সালে সোনালী ব্যাংকের তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে।
তার বিরুদ্ধে করা মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, তখন রেমিটেন্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে ব্যাংকের লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেয়।
এরপর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের বিভাগীয় তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ অভিযোগের ভিত্তিতে পরের বছর ১৯৮৬ সালে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনকে চাকরিচ্যুত করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, ১৯৮৫ সালেই হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো মামলা করে। এ মামলার বিচারে ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর রায়ে হরেন্দ্রনাথসহ সবাই খালাস পান।
এদিকে, গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ার অভিযোগে অন্য একটি মামলায় ১৯৮৬ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত সামরিক আদালতের বিচারে হরেন্দ্রনাথের সাত বছর কারাদণ্ড হয়। একই আদালত থেকে অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তিন বছর কারাগারের পর ১৯৯০ সালে মুক্তি পান হরেন্দ্রনাথ।
এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের পর বিশেষ সামরিক আদালতের সব কার্যক্রম বাতিল করে উচ্চ আদালত। এর ফলে হরেন্দ্রনাথসহ সবাই সেই মামলায় খালাস পান।
এরপর সামরিক আদালতে দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে এবং চাকরি হারানোর ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১২ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন হরেন্দ্রনাথ। রিট আবেদনের শুনানি শেষ হলেও অর্থঋণ আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকার কারণে রায় ঘোষণা হয়নি।
এর আগেই ১৯৮৮ সালে সোনালী ব্যাংকের তহবিল থেকে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অর্থ ঋণ আদালতে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
হরেন্দ্রনাথের অভিযোগ, গোপনে করা ওই মামলায় একতরফা রায় হয়।
রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেয় আদালত। এর বিরুদ্ধে আবেদন (মিস কেস) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার জেলা জজ আদালত আপিল গ্রহণ করেন; একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন।
এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাই কোর্টে আপিল করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট সেই আপিল খারিজ করে দেয় হাই কোর্ট।
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে ব্যাংক মামলাটির শুনানির কোনও উদ্যোগ নিচ্ছিল না।
‘যুগান্তকারী রায়’
২০২৩ সালে হরেন্দ্রনাথের হয়ে এই মামলাটি পরিচালনার জন্য সরকারি সংস্থা আইনগত সহায়তা কেন্দ্র (লিগ্যাল এইড) থেকে দায়িত্ব পান ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংক হরেন্দ্রনাথকে অহেতুক হয়রানী করতে এ মিথ্যা মামলা করে। ইচ্ছে করে মামলাটি দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করা হয়েছিল।
মিথ্যা মামলায় করার কারণে বাদীর ওপর ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের এ আদেশকে ‘যুগান্তকারী’ উল্লেখ করে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, “আমাদের দেশে ভুয়া মামলা, মিথ্যা মামলা এমনভাবে হচ্ছে, এসব মামলা বন্ধ করার জন্য ক্ষতিপূরণের আদেশ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করি।”
২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের এ আদেশ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ভুয়া মামলার করার ক্ষেত্রে বিরত থাকবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণকে উন্নত দেশে ‘কস্ট ফলো দ্যা ইভেন্ট’ বলে। যে মামলায় হারবে সে মামলার যাবতীয় খরচ বহন করবে। বাংলাদেশে এটার সূচনা হবে। আমি মনে করি, প্রত্যেকটি কোর্ট ‘কস্ট ফলো দ্যা ইভেন্ট’ করলে মামলার জট অর্ধেক কমে যাবে।”
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে হরেন্দ্রনাথ বলেন, “এ মামলা চালাতে গিয়ে ১৪ বিঘা ফসলি সম্পত্তি চলে গেছে। ভেটটা বাড়িঘর চলে গেছে। আমি ল্যান্ডলেস, হোমলেস। এ রায়ের জন্য কোর্টকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা যারা আমার বিষয়টি অন্যান্য সময় তুলে ধরেছেন, আপনাদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”