Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিশ্ব রাজনীতির ‘তীর্থস্থান’ হচ্ছে কি ট্রাম্পের ‘মার-এ-লাগো’

ফ্লোরিডার পাম বিচ শহরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাসস্থান ও ব্যক্তিগত ক্লাব মার-এ-লাগো।
ফ্লোরিডার পাম বিচ শহরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাসস্থান ও ব্যক্তিগত ক্লাব মার-এ-লাগো।
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হোয়াইট হাউস ছাড়তে আরও দুই মাস বাকি। জানুয়ারির ২০ তারিখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবেন তিনি। এরপর হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন ঘটবে ট্রাম্পের।

এই দুই মাস কি ট্রাম্প বসে থাকবেন? নিশ্চয়ই নয়। এরই মধ্যে তিনি ফ্লোরিডার পাম বিচ শহরে তার বাসস্থান ও ব্যক্তিগত ক্লাব মার-এ-লাগোকে পরিণত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কেন্দ্রে।

মার-এ-লাগোকে ‘রাজনৈতিক মহাবিশ্বের তীর্থস্থানে’ পরিণত করতে চাওয়ার কথা ট্রাম্প নিজেও একাধিকবার বলেছেন।

এ মুহূর্তে মার-এ-লাগো ঘেষা পার্ক, সমুদ্র সৈকত ও হোটেলের ব্যালকনি তাক করে আছে বিশ্বের তাবত মিডিয়া।

তারা বলছে, গত ৫ নভেম্বর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর দলে দলে মানুষ মার-এ-লাগো যাচ্ছেন তদবির করতে, যাতে ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে তাদের ঠাঁই হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরকারি আনুকুল্য নিশ্চিতের আশায়ও অনেকে পাম বিচে যাচ্ছেন, যেহেতু ট্রাম্প কেবল রাজনীতিক নন, একজন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ীও।

অন্য চাওয়া নিয়ে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়ার মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

কে নেই এই প্রত্যাশীদের দলে? ধনকুবের উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের সাবেক প্রধান কাশ প্যাটেল, নর্থ ডাকোটার গভর্নর ডগ বার্গামসহ আরও অনেকে ভিড় করছেন মার-এ-লাগোতে।

গুঞ্জন আছে, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিমন্ত্রী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে বার্গামের। মোদ্দা কথা, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দুই মাস আগেই মার-এ-লাগোতে বসে তার নতুন প্রশাসন গোছানোর তোড়জোর শুরু করে দিয়েছেন। শুনছেন দাবি-দাওয়া। এরই মধ্যে তিনি হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফের পদ চূড়ান্ত করে ফেলেছেন।

এর আগেরবার ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন মার-এ-লাগোকে তার শীতকালীন হোয়াইট হাউস বলা হতো। সেখানে তিনি রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাতেন। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করতেন। একই সঙ্গে বিশ্বের কোন প্রান্তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে হবে, বোমা ফেলতে হবে, সেই নির্দেশও দিতেন মার-এ-লাগো থেকেই।

ঠিক দুই বছর আগে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এই মার-এ-লাগোতেই অভিযান চালান যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এফবিআই) সদস্যরা। সেখানে এক বাথরুম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র ও গোয়েন্দা স্যাটেলাইট সংক্রান্ত গোপন নথি উদ্ধার করেছিলেন তারা।

দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে উচ্ছ্বসিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশে স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প।

মার-এ-লাগোর পরিস্থিতি

গত ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই রোবট কুকুরের টহল ও নৌকায় সশস্ত্র প্রহরীর নজরদারির মধ্যে মার-এ-লাগোতে ঢুকতে শুরু করেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ জন থেকে শুরু করে রিপাবলিকান পার্টির নেতা-সমর্থকরা। নিরাপত্তার দিক দিয়ে ২২৬ কক্ষবিশিষ্ট রিসোর্টটির সঙ্গে এখন মধ্যযুগের রাজা-বাদশাদের দুর্গের তুলনা সহজেই করা যায়।

নির্বাচনের রাতেই তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ককে ছেলেসহ মার-এ-লাগোতে থাকতে দেখা গেছে। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন।

মাস্কের মতো যারা মার-এ-লাগোতে ট্রাম্পের সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ পাননি, তারা অবশ্য মন খারাপ করেননি। তারা ভিড় করছেন আশপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁয়। তাদের অধিকাংশই চান, কোনোমতে চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের টিকেট পেতে বা নিদেনপক্ষে রাষ্ট্রের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে।

তাদের বাইরে আছে কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় পাওয়া ট্রাম্পের উল্লসিত ভক্তরা। তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে পাম বিচ।

ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে এ মুহূর্তে মার-এ-লাগোর নিকটবর্তী দ্য বেন হোটেলে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কেনেডি পরিবারের সদস্য রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। একই হোটেলে আছেন জর্জিয়ার ১৪তম কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্টের প্রতিনিধি রিপাবলিকান নেতা মারজোরি টেইলর গ্রিন।   

মার-এ-লাগোর কাছাকাছি আরেক নামিদামি হোটেল দ্য ব্রেকারসে আছেন ট্রাম্পের বন্ধু ডানা হোয়াইট। তিনি লাস ভেগাসে মার্শাল আর্টবিষয়ক প্রচার সংস্থা আল্টিমেইট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।

নির্বাচনের রাতে ডানা হোয়াইটও ট্রাম্পের সঙ্গে মার-এ-লাগোতে ছিলেন। হোয়াইট অবশ্য বলেছেন, কোনও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে লাস ভেগাস থেকে ফ্লোরিডায় আসেননি তিনি।

ডানা হোয়াইটের দাবি ভুল নাও হতে পারে। রিপাবলিকান পার্টির এক অভ্যন্তরীণ সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, ট্রাম্প ভিড় পছন্দ করেন। মানুষ তাকে তোষামোদি করছে, ঠেলেঠুলে তার সামনে আসতে চাইছে- এসব দৃশ্য দেখতে তিনি বরাবরই ভালোবাসেন।

ওই সূত্রের ভাষ্য, মার-এ-লাগোতে ভিড় করা ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, তারা ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে কোনও পদ চান না।

আরকানসাসের সেনেটর টম কটন তাদের একজন। তিনি জানিয়েছেন, ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনে কাজ করতে তিনি ইচ্ছুক নন। বরং সেনেটে নেতৃত্বস্থানীয় পদের প্রতি আগ্রহ আছে তার।               

মার-এ-লাগোতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের সঙ্গে ধনকুবের ইলন মাস্ক। কোলে ছেলে টেকনো মেকানিকাস।

এবার কেমন প্রশাসন চান ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইচ্ছা, এবার তার প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ পদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন একটা রাখবেন না। এবার প্রশাসনকে ভিন্নভাবে ঢেলে সাজাবেন।

আগের বার অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ‘মন্দ ও অবিশ্বস্ত মানুষদের’ প্রশাসনে জায়গা দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছিলেন তিনি।      

তার ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার বাবার চেয়ে জানে বোঝে বেশি- এমন ব্যক্তিদের তিনি এবার প্রশাসনে চান না। দুর্ভোগে ফেলার মতো মানুষদের তিনি বাদ দিতে প্রস্তুত।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দক্ষতা-যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যকেই এবার বেশি গুরুত্ব দেবেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। নির্বাচনের একেবারে প্রথম ‍দিন থেকে যারা তার পাশে ছিলেন, বিপদে-আপদে তাকে ছেড়ে যাননি, তালিকায় তাদের উপরে রাখবেন তিনি।   

হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ হিসেবে সুসি ওয়াইলসকে বেছে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ফ্লোরিডা গুরুত্ব পেতে পারে বেশি

রিপাবলিকান রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ম্যাক্স গুডম্যানের মতে, হোয়াইট হাউসে এবার ফ্লোরিডার জোয়ার দেখা যেতে পারে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ হিসেবে ট্রাম্প চূড়ান্ত করেছেন এই অঙ্গরাজ্যেরই রাজনীতিক সুসি ওয়াইলসকে। ৬৭ বছর বয়সী এই রাজনৈতিক পরামর্শদাতা দুই মাস পর হোয়াইট হাউসের প্রথম নারী চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।

নির্বাচনের সময় ফ্লোরিডায় সুসি ওয়াইলসের পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করেছিলেন একই অঙ্গরাজ্যের লবিং সংস্থা অ্যাডভোকেসি পার্টনারসের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্লেটার বেলিস। তার সমর্থন মূলত ওয়াইলসের পক্ষেই ছিল।

তাকে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ করার খবরে স্লেটার বেলিস বলেন, “আমেরিকায় ভোটের রাজনীতিতে সুসিকে লৌহমানবী বলা যায়।”      

তিনি বলেন, “আমেরিকার রাজনীতিতে বর্তমানে ফ্লোরিডার মতো ভালো অবস্থানে অন্য কোনও অঙ্গরাজ্য নেই। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এখানকার। সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরামর্শদাতা থেকে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ বনে যাওয়া নারীও এই অঙ্গরাজ্যের।”

মার-এ-লাগোর চারপাশ সবসময় টহল দেয় সশস্ত্র প্রহরী।

‘রাজনৈতিক মহাবিশ্বের তীর্থস্থান’ মার-এ-লাগো?

আশির দশকে দক্ষিণ ফ্লোরিডার পাম বিচ শহরে মার-এ-লাগো রিসোর্ট কেনার সময় ট্রাম্পকে কেউ সেখানে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়নি। এখন এই শহর ‘মেইক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন’ দেশে পরিণত হয়েছে। কয়েক দশকের মধ্যে ট্রাম্প একটি গোটা শহরের ভোল পাল্টে দিয়েছেন। পাম বিচের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে বিক্রি হচ্ছে ট্রাম্প ব্র্যান্ডের অন্তর্বাস, মাথার টুপি থেকে শুরু করে আরও কত কী!

কেবল রিপাবলিকান বা তাদের সমর্থকরা নন, বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরাও এখন হোয়াইট হাউসে না গিয়ে এই পাম বিচে আনাগোনা শুরু করতে যাচ্ছেন।        

আগামী সপ্তাহে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার মিলেই মার-এ-লাগো যাচ্ছেন ট্রাম্প ও মাস্কের সঙ্গে দেখা করতে।

১৭ একর জমিতে গড়ে তোলা এই রিসোর্টেই বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্স (সিপিএসি)। এই সম্মেলনের টিকেটের মূল্য ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ডলার।             

লবিং সংস্থা অ্যাডভোকেসি পার্টনারসের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্লেটার বেলিসের ধারণা, ট্রাম্প এবার যতটা সম্ভব ফ্লোরিডায় বেশি সময় কাটাবেন।

আর তেমনটা হলে ৬২ হাজার ৫০০ ফুট বর্গফুট আয়তনের মার-এ-লাগোকে ‘রাজনৈতিক মহাবিশ্বের তীর্থস্থানে’ পরিণত করার ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপ পাবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত