Beta
মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

জগন্নাথ হল যেভাবে ঢাকায় সরস্বতীর আরাধনার কেন্দ্র হয়ে উঠল

স্বরস্বতী
বুধবার স্বরস্বতী পূজাকে সামনে রেখে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে দেবীমূর্তি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছবি তুলেছেন জীবন আমীর।
[publishpress_authors_box]

বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবীর আরাধনায় ঢাকায় যতগুলো পূজা হয়, তার অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আয়োজন। সরস্বতী পূজা দেখতে ইচ্ছুক নগরবাসী একবার হলেও এই উৎসবে অংশ নিতে চেষ্টা করেন। সময়ের সঙ্গে ঢাকার সরস্বতী পূজা আর জগন্নাথ হল যেন পরিপূরক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই হলে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হতো। তবে তখন এমন বিপুল আয়োজন হতো না।

হলের সাবেক কর্মচারী শ্রীধাম দাস জানালেন সেসব কথা।

১৯৬৩ সালে প্রথম জগন্নাথ হলে কর্মচারীদের সহকারী হিসেবে যোগ দেন শ্রীধাম। সময়ের সঙ্গে নিজে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন, এক পর্যায়ে অবসরও নিয়েছেন। এখন হলের সন্তোষ চন্দ্র ভবনের নিচে একটি দোকান চালান।

জগন্নাথ হলের পূজার একাল-সেকাল জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগে তো এত আলো ছিল না, এখন অনেক লাইট। সময় গেছে, সবই উন্নত হয়েছে।

সরস্বতী
জগন্নাথ হলে চলছে সরস্বতী পূজার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

“স্বাধীনতার আগে থেকেই এখানে পুজো হয়। আগে শুধু হলের মন্দিরে পুজো হতো। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে মণ্ডপের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো হল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হতো পুজো।”

জগন্নাথ হলের প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা জানান, আগে হলের বিভিন্ন ভবনের সামনে পূজা হতো। পুকুর পাড়, গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবনের সামনের বাগানে, শহীদ বধ্যভূমির পাশে মাঠের কিছু জায়গায় এবং টেনিস কোর্টের আশপাশেই বসানো হতো মণ্ডপ। এক সময় ভবনগুলোর বিভিন্ন তলায়ও পূজার আয়োজন করা হতো।

ধীরে ধীরে মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ে, ভক্ত-দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ফলে হলের ভেতর দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলছিল সরস্বতী পূজার আয়োজন।

১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সনজিৎ কুমার দত্ত এখন জগন্নাথ হলের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি জানান, ২০০৭ সালের মে মাসে প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন অজয় কুমার দাস। তিনি পূজার আয়োজনে শৃঙ্খলা আনার সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্দেশে ২০০৮ সাল থেকে মাঠে সব মণ্ডপ তৈরি করে পূজা শুরু হয়।

তখনই ঠিক হয়, প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে। এখনও সেই ধারাবাহিকতা চলছে বলে জানান সনজিৎ।

তিনি বলেন, “মণ্ডপ তৈরির জন্য জায়গা চেয়ে সব বিভাগকে আবেদন করতে হয়। আবেদন করার সময়ের ভিত্তিতে বিভাগগুলোকে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। সেই সিরিয়াল হিসেবে পরে লটারি হয়।

“লটারিতে সিরিয়ালের ধারাবাহিকতায় সব বিভাগ টোকেন তোলে, সেই টোকেনে যে সংখ্যা ওঠে সেটিই তাদের স্টলের নম্বর। লটারির সময় সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা থাকেন, তারাই লটারি করেন, ফলে কারও মন খারাপের কিছু থাকে না।”

এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২টি বিভাগ সরস্বতী পূজায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে চারুকলা অনুষদের মণ্ডপটি বসছে হলের পুকুরে, কেন্দ্রীয় উপসানালয়ে হচ্ছে একটি পূজা এবং বাকি ৭০টিই হলের কেন্দ্রীয় মাঠে।

মঙ্গলবার জগন্নাথ হলের খেলার মাঠ ঘুরে দেখা যায় শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা চলছে স্টলগুলোয়। বরাবরের মতোই সবার চেয়ে আলাদা চারুকলা অনুষদের মণ্ডপ। হলের বিশাল পুকুরের মাঝখানে ৪৫ ফুট উঁচু প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে।

চারুকলার শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে দ্রুতলয়ে। কারণ রাতের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে মণ্ডপে যাওয়ার ভাসমান পথ।

শ্রীধাম দাস বলছিলেন, চারুকলার শিক্ষার্থীরা পুকুরের মাঝে যে চমৎকার মণ্ডপ তৈরি করেন তা দেখতেই এখন লাখো মানুষের ঢল নামে।

সরস্বতী
সরস্বতী প্রতিমায় লাগছে শেষ মুহূর্তের তুলির ছোঁয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে ছবি তুলেছেন জীবন আমীর।

কেমন হবে এবারের চারুকলার প্রতিমা, জানতে কথা হয় প্রাচ্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত বসাক অর্ণবের সঙ্গে।

তিনি জানান, মাস খানেক ধরে চলছে প্রতিমা গড়ার কাজ। এবারের বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরো প্রতিমাই তৈরি করা হচ্ছে বাঁশ ও চটের সাহায্যে।

পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এবার আমরা প্লাস্টিক জাতীয় সামগ্রী ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, “শুধু প্রতিমার মাথা, বাহন হাঁস এবং টুকটাক কিছু কাজে থার্মোকল শিট ব্যবহার করা হয়েছে, এছাড়া সমগ্র কাঠামোই বাঁশের তৈরি।”

এবার চারুকলার সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিমা গড়ার কাজে অংশ নিয়েছেন বলে জানান সুদীপ্ত। তিনি বলেন, “প্রতিমা গড়ায় অনেক ধরনের কাজ থাকে। ফলে যে যখন সময় পায় এসে কাজে হাত লাগায়। এভাবেই প্রতিমার কাজ করি আমরা।”

প্রতিমা ও মণ্ডপ তৈরির ক্ষেত্রে ধর্ম কোনও বাদা নয় জানিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, “চারুকলার প্রায় সব শিক্ষার্থীরাই এই কাজে যুক্ত হন। এটা শুধু হিন্দু শিক্ষার্থীদের পুজো না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীরই উৎসব। সবাই সবার মত করে এ আয়োজনে অংশ নেয়।”

জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের দায়িত্বে আছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সাহা।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটাতো শুধু পুজো না, এটি উৎসব। বাংলাদেশের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় মণ্ডপে মণ্ডপে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন যে মণ্ডপ তৈরি করে তা থিমভিত্তিক হয়। ফলে প্রত্যেকটি মণ্ডপই আলাদা হয়। তাতে দর্শনার্থীরাও দেখে আনন্দ পান।”

কিন্তু পূজা ঘিরে যে জন সমাগম হয় তা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় বলে জানালেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, যে পরিমাণ মানুষ পূজা দেখতে আসেন তাদের চলাচলের জন্য আরও চওড়া সড়ক প্রয়োজন। তারপরেও সবাই মিলে ভালো একটি পূজার আয়োজনের চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।

দর্শনার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারেন সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সহযোগিতা করবেন বলে জানান প্রভোস্ট।

তিনি বলেন, “এত আয়োজনের পরও নানান অসঙ্গতি থেকে যায়। এর জন্য যারাই পূজা ঘুরতে আসবেন তারা এটাকে নিজের ভেবে সহযোগিতা করলে আয়োজন আমাদের জন্য আরও সহজ হবে।

“এ উৎসব সবার। এটা বাঙালি কৃষ্টি-ঐতিহ্যের উৎসব। আমি সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই কারণ উৎসব সবাই মিলে না করলে সেই উৎসবে আনন্দ হয় না।”

সনাতন ধর্ম অনুসারে, সরস্বতী বিদ্যা, বাণী ও সুরের দেবী। মাঘের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সাদা হাঁসে চেপে দেবি সরস্বতী জগতে আসেন। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পূজার দিন সকালে দেবীকে দুধ, মধু, দই,ঘি,  কর্পূর, চন্দন দিয়ে তাকে বরণ করা হয়।

জগন্নাথ হল ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলেও আলাদা আলাদা পূজার আয়োজন করা হচ্ছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম এই ধর্মীয় উৎসবে বুধবার বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন অগণিত ভক্ত। বিতরণ করা হবে প্রসাদ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত