একবার, দুবার নয়, টানা সাত বার বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ নির্বাচিত হয়েছে ফিনল্যান্ড। ২০১৮ সালে শুরু, তারপর থেকে শীর্ষেই থাকছে।
কিন্তু কী সেই রহস্য, যে কারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশটি সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে নিজেদের ধরে রেখেছে। তা নিয়ে কৌতূহল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
প্রতি বছর ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস পালিত হয়। এই দিবসকে সামনে রেখেই বুধবার জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৪’। এতে সহায়তা করেছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন)।
এবারের প্রতিবেদনে জরিপের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ১৪৩টি দেশকে। সুখের বিচারে তালিকার শীর্ষে ফিনল্যান্ড ও শেষে আফগানিস্তান।
সুখ সূচকটি তৈরি করা হয় ব্যক্তির জীবনযাত্রার সন্তুষ্টির ওপর নিজস্ব মূল্যায়ন, মাথাপিছু আয়, সামাজিক সহযোগিতা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, স্বাধীনতা, উদারতা ও দুর্নীতির উপর ভিত্তি করে।
এখন প্রশ্ন আসে, ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে অন্যরা কী শিখতে পারে?
ফিনল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী, সুখ বিষয়ক গবেষক ও আলটো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ফ্র্যাংক মার্টেলার মতে, ফিনিশরা তিনটি কাজ কখনও করে না, যা তাদের সুখকে নষ্ট করতে পারে না। এগুলো হলো- বলবেন না ও দেখাবেনও না, প্রকৃতির সুবিধা উপেক্ষা না করা ও সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ভঙ্গ না করা।
ফিনিশরা কখনও নিজেদের সফলতা বা সম্পদের বড়াই করে না। দেশটির ধনীরাও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন। তারা শ্রেণী ভেদাভেদ ও বৈষম্য ছাড়াই একত্রে বাস করেন।
উনিশ শতকের এক বিখ্যাত ফিনিশ কবির একটি বিখ্যাত উক্তিতে তাদের সুখে থাকার কারণ পাওয়া যায়। লাইনটি এমন – ‘নিজের সুখের সঙ্গে অন্যের তুলনা করো না, বড়াইও করো না’।
২০২১ সালের এক জরিপ বলছে, ৮৭ শতাংশ ফিনিশ মনে করেন প্রকৃতি তাদের জন্য আশীর্বাদ। এটি তাদের মনে শান্তি ও শক্তি দেয়।
উত্তর মেরুর কাছের দেশ ফিনল্যান্ডে কর্মীরা গ্রীষ্মকালে এক মাসের ছুটি পায়। এসময় তারা গ্রামাঞ্চলে ছুটি কাটায়। গবেষণা বলছে, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটালে জীবনীশক্তি ও সুস্থতা বাড়ে।
ফিনিশরা তাদের বিশ্বস্ততা ও সততার জন্যও পরিচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি দেশের মধ্যে বিশ্বাসের মাত্রা যত বেশি, তার নাগরিকরা তত বেশি সুখী হয়। দেশটির রাস্তায় কারও কোনও জিনিস হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাওয়ার হার ৯০ শতাংশ।
ফিনল্যান্ড কর্মচারীবান্ধব কর্ম সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। দেশটির কর্ম সংস্কৃতি একাধিক বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে – নিম্ন স্তরবিন্যাস, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা, কর্মীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া ও পরামর্শ গ্রহণের মতো বিষয়।
কর্মীরা তাদের কাজের সময়সূচি নিজের মতো করে গড়াপড়তা তিন ঘণ্টা আগে বা পরে শুরু ও শেষ করতে পারে। ফলে তারা ব্যক্তিগত দায়িত্ব সামলাতে পারে। এই সুবিধা কর্মীদের চাকরির সন্তুষ্টি, কাজের দক্ষতা ও সুখ বাড়াতে সাহায্য করে।
ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত। সেখানকার মানুষেরা সততা ও আন্তরিকতাকে গুরুত্ব দেয়। এ কারণে অবৈধ উপায়ে আরও বেশি অর্থ উপার্জনের চাপ নেই তাদের।
ফিনিশরা মানবিক সম্পর্ককে সবার আগে গুরুত্ব দেয় এবং কর্মক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত জীবনে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে। তারা একে অন্যেকে মানসিক, তথ্যগত ও বাস্তবিক সমর্থন দেয়, যা তাদের সুখ ও সুস্থতা বাড়ায়। প্রতিটি ফিনিশের কঠিন সময়ে নির্ভর করার মতো কেউ না কেউ অবশ্যই থাকে।
ফিনল্যান্ডে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সম্পূর্ণ শিক্ষাই বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষার জন্য কোনও খরচ লাগে না। এতে অভিভাবকদের উপর মানসিক ও আর্থিক চাপ কমে। সবাই খুশি মনে বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। শুধু তাই নয়, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় জীবনযাপনের দক্ষতা শেখানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সুখ নিয়ে ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি
জাতিসংঘ যতই বলুক ফিনল্যান্ড সবচেয়ে সুখী দেশ, কিন্তু দেশটির বাসিন্দাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু আলাদা। তাদের মতে, এই সূচকটি আরও জটিল বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।
ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি ইউনিভার্সিটির সুখবিষয়ক গবেষক জেনিফার ডি পাওলা বলেন, “জাতিসংঘের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তা হলো ‘বর্তমানে আপনি আপনার জীবনে কতটা সন্তুষ্ট?’। এখানে কিন্তু সুখের কোনও উল্লেখ নেই।
“সুখ মূলত আবেগ ও আবেগ প্রকাশের উপর নির্ভর করে। হাসি, প্রফুল্লতা ও আনন্দ জীবনের সন্তুষ্টির ধারণার চেয়ে সুখের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। এই সূচককে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বলার চেয়ে লাইফ স্যাটিসফেকশন রিপোর্ট বলাই ভালো।”
ফিনিশরা কিন্তু নিজেদের সুখী মানুষ মনে করে না।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লারিভারা বলেন, “ফিনিশরা আশাবাদের পরিবেশ তৈরিতে তেমন ভালো নয়। তবে হতাশাবাদ ও সন্তুষ্টি একই সঙ্গে থাকতে পারে।”
জরিপে অংশগ্রহণ করা এক ফিনিশের বক্তব্যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। ওই ব্যক্তিকে ফোন দিয়েছিলেন জরিপ কর্মকর্তারা।
তিনি বলেন, “তারা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে যে, আমরা কি আমাদের এই জীবনকে পছন্দ করি কি না? উত্তরে আমি বলেছি, এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে, আপনি আগামীকাল আবার ফোন করুন।”
তথ্যসূত্র : বিজনেস ইনসাইডার, ইকোনোমিক টাইমস ও ডব্লিউএইচআর