Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ঢাকার প্রথম ফাউন্টেন পেন কোম্পানি

আমিন বাবু। প্রতিকৃতি অঙ্কন: মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু।

ঢাকা— কারও কাছে মসলিনের শহর, কারও চোখে মসজিদের। আসলে ঢাকাইয়্যা আর বাঙালের প্রাচীন নগর ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেকটাই ঢাকা পড়ে আছে। তবে, সেই যে রাজমহল থেকে স্থানান্তর হয়ে ঢাকা মুঘল রাজধানীতে রূপ নিল, তার পর থেকে এই বোবা নগরীর উত্থান-পতনের অনেক সাক্ষ্যই পাওয়া যায়। এই মেগা সিটির টাইমলাইনে উত্তাল সময়ের কথা যেমন আছে, তেমনি চাপা পড়ে আছে অসংখ্য অব্যক্ত কাহন। যার অন্যতম হচ্ছে কলম, কালির উৎপাদন শিল্প আর দেশীয় শিক্ষা উপকরণের ইতিহাসে ঢাকার অবদান। এই ইতিহাসের শিকড় প্রোথিত কয়েক শতাব্দী আগে। বাংলার ভাটি অঞ্চলে শিক্ষা ও লেখন-সরঞ্জামের সম্পর্কটা প্রাচীন সমাজ থেকে হাত-ধরাধরি করে উঠে আসা। সেই সম্পর্কের আলাপটা গোড়া থেকে শুরু করা যাক।

অতীতে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে বই বাঁধাই হতো। কুইল আর ডিপ পেন দিয়ে লেখা এমন অসংখ্য পাণ্ডুলিপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে অন্যতম, পুঁথি ও ধর্মগ্রন্থ। এসব স্ক্রিপ্ট একাধিক কপি করতে চাইলে বারবার হাতে লেখা ছিল কাষ্টসাধ্য, তাই ছাপাখানা আবিস্কার হয়।

পর্তুগিজরা ১৫৫৬ সালে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলে তখন থেকে লেখালেখির ধরন কিছুটা পাল্টে যায়। ছাপার কালি, কাগজ আর অন্যান্য সরঞ্জামের সাথে পরিচয় ঘটে অধিক সংখ্যক ব্যবহারকারীর। যদিও এসব প্রেসের উদ্দেশ্য ছিল কেবল বাইবেল ছাপানো। পর্তুগিজদের প্রথম ছাপাখানার ২০০ বছর পর হুগলিতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সময়ও একই রকম ব্যাপার ঘটেছিল। ১৭৭৮ সালে ওই প্রেস কাজ শুরু করার কারণটা ছিল চার্চের মিশন আর ইংরেজি শিক্ষা বেগবান করা। এই উদ্যোগটা পরে ইওরোপীয় আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে যায়। যার ধারাবাহিকতায় ১৮৩৫ সালে ঢাকায় গভর্নমেন্ট কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা।

ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের সমসাময়িক কালেই স্থানীয় শিক্ষা উপকরণের ইতিহাস নিভৃত পথে হাঁটা শুরু করে। একথা বলার কারণ, একদিকে বহুমাত্রিক শিক্ষামাধ্যম অন্যদিকে নিব ও কলম শিল্পের যুগপৎ উৎকর্ষতা। আগেই বলেছি, ধর্মীয় ও সাধারণধারার শিক্ষার্থীরা শ্রেণিভেদে ভিন্ন লেখনি ব্যবহার করত। আবার গ্রাম ও শহরের ক্ষেত্রেও লেখন সামগ্রীর ব্যবহারে বৈষম্য ছিল লক্ষণীয়। এসবই প্রভাব ফেলেছে পূর্ববঙ্গের লেখন সরঞ্জামে।

কলমের বিবর্তনের একটি কাল পরিক্রমা (পেন্সএক্সপ্রেস এর সৌজন্যে)

তরল কালির নর্তকী ঝরনা কলম
আজকের ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২০০ বছর আগে নিব তৈরির কারিগর ছিল। গবেষণায় তাদের নাম ঠিকানাও পাওয়া গেছে। সেটা ছিল শতভাগ দেশি খোলা কলমের যুগ।

এরপর আসে ‘ঝরনা’ কলমের দাপট। এই কলম একটা যাদু। ডিপ, কুইল, রিজার্ভার সব হটিয়ে একক কর্তৃত্ব নিয়ে সে আসীন হয়েছে সভ্যতার মসনদে। বলপেন যুগের শিশু কিশোররা এই কলমের ভেতর লুকানো বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা (ক্যাপিলারি সিস্টেম) সম্পর্কে কখনোই জানবে না। কী আশ্চর্য এর ম্যাকানিজম। কোনও ব্যাটারি লাগে না, মাদারবোর্ড নেই, এর চালনায় কোনও স্যাটেলাইট সংযোগ প্রয়োজন হয় না অথচ দিব্যি নেচে চলেছে তরল কালির নর্তকী।

সত্যিই, ঝরনা কলমের কারিগরি প্রকল্প বিস্ময়কর প্রযুক্তি। আমাদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে চিরঞ্জীব কাঠামোয় আবদ্ধ করছে এটি। শিল্পীর হর্ষোৎফুল্লতা, বিজ্ঞানীর তপস্যা আর উদ্ভাবকদের চিত্তহারী ভাবনা ভাবালুতার ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে এই কলমের বদৌলতে। দৈনন্দিন ব্যবহার ছাড়াও ক্যালিগ্রাফি ও চিত্রাঙ্কনের কাজে এর কদর এখনও ঈর্শ্বনীয়। খোলা নিব থেকে এর উত্তরণ হয়েছে কয়েকটি ধাপে।

ঢাকায় এই ঝরনা কলম কিভাবে এল আর কারা বানাল। সেই ইতিহাস অনুল্লেখিত এবং উপেক্ষিত। দীর্ঘ গবেষণায় যতটুকু জানা গেছে তা নিয়েই এই রচনা।

মেড ইন ঢাকা ঝরনা কলম
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানেও প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে একসময় ডিপ পেন বা খোলা নিব হাতে উঠে আসে। খোলা নিব দিয়ে লেখালেখি একটানা চলেছে দীর্ঘকাল। এই নিব থেকে দেশি কলমে উত্তরণের ধারাবাহিকতায় আমাদের বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আর দেশভাগ বড় ধাক্কা ছিল বাঙালি উদ্যোক্তাদের জন্য। বঙ্গভঙ্গের পর দেশভাগ ছিল আরও কঠিন সময়। বাস্তুচ্যুত বণিক আর কারিগরদের যন্ত্রপাতি, নথিপত্র রীতিমতো দুর্লভ। সে জন্যই ১৯৪৭ সালের আগে-পরের কলম তৈরির মাঠপর্যায়ের তথ্য খুবই কম।

ষাটের দশক থেকে ইনজেকশন মোল্ডের দিকে ঝুঁকে পড়লে প্লাস্টিকের মতো সুলভ কাঁচামালে ফাউন্টেন পেন তৈরি হয় ঢাকায়। তার আগে পর্যন্ত ইবোনাইটের কলম বিশ্বজুড়ে হাতে তৈরি হলেও এখানে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুতরাং সেই হিসেবে ঢাকায় প্রথম ঝরনা কলম কারখানা গড়ে ওঠে ১৯৬০ সাল নাগাদ। এর পুঁজি এসেছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। মুখ্যত দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ভালো লেখনসামগ্রীর উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়ে। মানসম্পন্ন পণ্যের চাহিদা মেটাতে অভিজাতদের স্বার্থে কিছু আমদানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার যেভাবে কালি ও কলম আমদানি বন্ধে ডিক্রি জারি করেছিল, সেই সিদ্ধান্ত অনুকরণে ১৯৬৫ সালের পর ঢাকায় সরকার আমদানিতে উচ্চ হারে করারোপ করে। এ কারণে স্থানীয় শিল্প বিকাশে সহায়ক পরিবেশ লাভ হয়। নীতি সুরক্ষার ফলে শিল্প খাতে জন্ম নিয়েছিল ঝরনা কলমের ‘মেড ইন ঢাকা’ সংস্করণ।

মেড ইন ঢাকা ঈগল পেন।

তখন কলম একটি অতিপ্রয়োজনীয় গ্যাজেট এবং একই সাথে হালের ফ্যাশন। দেশীয় কলম বলতে তখন রংচঙে, চলতি মডেলের কপি বা একটু ফ্যাশনেবল লেখনসামগ্রীর দিকে ঝোঁক দেখা যেত। বিদ্যার্থীদের কাছে এসব ফাউন্টেন পেনের কদর ততটাই ছিল, যতটা ছিল নারীর কাছে মিহি বস্ত্রের। ‘সরকার ই আলা’, ‘নয়নসুখ’, ‘মলমল খাস’ বা সবচেয়ে বনেদি ‘আব এ রাওয়া’ যেমন ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি তৈরি করেছে, তেমনি ‘পি এন’, ‘ঈগল’, ‘বেলা’ ইত্যাদি ঝরনা কলমও ঢাকার নাম রৌশন করেছে। সবই পাকিস্তান আমলের কথা।

ঢাকার স্টেশনারি দোকানগুলোয় সুদৃশ্য প্যাকেটে বিক্রি হতো ফাউন্টেন পেন। যদিও ততদিনে দু-একটা করে কারখানা খুলতে শুরু করেছে। মাদ্রাজ আর বোম্বের সাথে সমান তালে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা হতো এসব কারখানায়। কারণ, তাঁরা জানতেন, ফাউন্টেন পেন অনেকের কাছেই লাইফটাইম অপশন। একবার কিনলে যদি না হারায়, তাহলে তো লিখেই জীবন পার করে দেওয়া যায়। একটি মানসম্পন্ন কলম পেতে হাত খুলে অর্থ খরচ করতে দ্বিধা করবেন না শিক্ষিতজনেরা। অল্প দিনেই ঢাকার বাজার দেশি-বিদেশি কলমে ভরে উঠল।

এমন সুদৃশ্য বক্সে বিক্রি হতো ঢাকার ঈগল ফাউন্টেন পেন।

পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় বেশ কিছু কলম কোম্পানি গড়ে উঠেছিল। এসব কারখানা প্রতিষ্ঠা পায় বাঙালি-অবাঙালি একক অথবা যৌথ মালিকানায়। করাচি, রাওয়ালপিণ্ডি, পেশোয়ার আর ইসলামাবাদের কিছু ব্যবসায়ী বুড়িগঙ্গাতীরে কলমের কারখানা গড়ে তুলতে প্রথম দিকে উদ্যোগী হলেন। এঁদের মধ্যে কেউ সফল হলেন আর বাকিরা ফিরে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। পাঠানদের দেখাদেখি অনেক হিন্দু ব্যবসায়ি পুঁজি খাটিয়েছিলেন। অল্প দিনেই কয়েকটি ব্র্যান্ডের ফাউন্টেন পেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এদের অন্যতম ছিল ঈগল। জনপ্রিয়তার দিক থেকে যেকোনও কোম্পানির তুলনায় ঈগল ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। যতদূর জানা যায় ১৯৬২ সালে এই কোম্পানির গোড়াপত্তন। মডেল ছিল পশ্চিমা ফাউন্টেন পেনের অনুকরণে। একটানা দীর্ঘসময় এর বাণিজ্য ছিল। খুব মজবুত কলম তৈরি করতে পারত কোম্পানিটি। পূর্ব পাকিস্তান আমলে ঢাকার প্রথম ঝরনা কলম হিসেবে এখনও ঈগলের নামই পাওয়া যায়।

ঢাকার আরেক বিখ্যাত ফাউন্টেন পেন কোম্পানি বেলা।

১৯৬৯ সালে ঢাকায় ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হলে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। উত্তাল এই সময়ের প্রভাব হানা দেয় সব অঙ্গনে। কলম কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা গোটাতে থাকে। ঈগলের সমসাময়িক কোম্পানিগুলোর অনেক মালিকই এখনও বেঁচে আছেন। তাঁরা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈগল-এর কারখানার উর্দুভাষী মালিকসহ গোটা পরিবার পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। দেশ স্বাধীনের পর ঈগল ব্র্যান্ডের কলম ফের দেখা যায়। ঈগলের মালিক এবং পুঁজি চলে গেলেও এখানে থেকে গিয়েছিল তাদের যন্ত্রপাতি আর লোকবল। সেই লোকবল আর যন্ত্রের সাথে নতুন মূলধন দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশি ঈগল কোম্পানি। রহমতগঞ্জের ব্যবসায়ী হাজি ইউসুফ চকবাজার এলাকায় ঈগল পেন তৈরি ও বাজারজাত শুরু করেন। ব্র্যান্ডটি তার পুরনো ট্রেডমার্ক নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে এবং সাফল্য আর সুদিন ফিরিয়ে আনে।

এরপর বড় ব্র্যান্ড বলতে ছিল বেলা ফাউন্টেন পেন। ১৯৬৮ সালে হাজি আবদুল ওয়াহাব এই ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। পরে তাঁর বড় ছেলে আবদুল ওয়াহেদ পরিসর বৃদ্ধি করেন। অর্থাৎ এটিও পূর্ব পাকিস্তানকালে গোড়াপত্তনকৃত কোম্পানি। কিন্তু ঈগলের সাথে এর পার্থক্য হলো বেলার মূলধন শতভাগ দেশি। চকবাজারের হাজি আব্দুল ওয়াহাব এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। পকেট ও ডেস্ক— দুই ধরনের কলমই বানাতেন তাঁরা। ঢাকার আজগর লেনের ৩৮ নম্বর বাড়িটি ছিল বেলা পেনের কারখানা।

ঈগল ও বেলার পরই ছিল ঢাকার মাস্টার পেন কোম্পানির খ্যাতি।

আরেকটি কলম ছোটবেলায় খুব দেখতাম মনে আছে। নাম ছিল মাস্টার। এই মাস্টার কলমের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বেলা কোম্পানির একটি ঘটনা। কোনও এক কারণে বেলা পেনের ম্যানেজার মালেক মিয়াকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে মালেক মিয়া নিজেই গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র ফ্যাক্টরি, বাজারে আসে মাস্টার পেন।

ঈগল, বেলা ও মাস্টার— এই তিন চালু ফাউন্টেন পেনের বাইরে লালবাগের হাজি নূর ইসলামের ‘ডায়মন্ড’, নবাবগঞ্জের হাজি আবদুল মান্নানের ‘ঊষা’ পেন, ইমামগঞ্জের হাজি মো. শরীফের ‘সুলতান’ পেন ছিল জনপ্রিয়। এছাড়া ‘এপিসি’, ‘ওরিয়েন্ট’, ‘কুমকুম’, ‘নবীন’, ‘সিতারা’, ‘রনি’, ‘প্রাইমেক্স’, ‘সোয়ান’, ‘রাইটার’, ‘জি এস’, ‘লায়ন’, ‘অস্ট্রিচ’ ইত্যাদি ঝরনা কলম ঢাকার বাজারে উপলব্ধ হতো খুব সুলভে।

ঢাকার সুলতান ফাউন্টেন পেন।

বেশির ভাগই ছিল সিগার শেপ ছোট পকেট পেন। গঠন আর প্রকৃতি দেখে ধারণা করা যায়, কলমগুলো বস্তুত ছাত্রদের টার্গেট করে বানানো এবং এর বিনিময়মূল্য বেশ সাশ্রয়ী।

বলপেনের যুগে টিকে থাকার লড়াই
ঢাকার কলম ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতার পর কারখানাগুলো জমজামট ব্যবসা করেছে একটানা বিশ বছর। তারপর বলপেন চলে এলে দুর্দিন শুরু হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১৯৯০ সালের পরও অনেক কলম কারখানা টিকে ছিল। কিছু কারখানা কলম বানাত নির্দিষ্ট জেলায় বসে বা শুধু একটি এলাকার চাহিদা মেটাতে। ঢাকার অনেক কলমের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গেছে। কিছু কলম বানানোর পরই সদরঘাট হয়ে লঞ্চে চলে যেত দক্ষিণের বিভিন্ন জেলায়। উৎপাদনের পর পুরো লট গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যেত। কেননা, এসব কলম এতটাই সাধারণ ছিল যে রাজধানীতে তার ক্রেতা খুব কম। তা ছাড়া গ্রামে তখনও বলপেন যায়নি।

বড় শহরগুলোর জন্য যেসব ঝরনা কলম বানানো হতো, তার দাম কিছুটা বেশি ছিল। সেই তুলনায় খুব সস্তায় জেলা পর্যায়ে উৎপাদন বা বিক্রি হতো প্লাস্টিকের তৈরি ফাউন্টেন পেন। আদালতপাড়া ও স্কুল এরিয়াতে সুলভ কলম বেশি বিক্রি হতে দেখা যেত। অনুমোদনহীন অনেক কোম্পানি ঝরনা কলমের প্রকৌশল নকল করে লুকিয়ে কলম বানাত এবং সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাজারজাত করত।

মেধাস্বত্বের ফাঁকি আর নীতিসহায়তার অভাব দুই দশকে এই শিল্পের উল্লম্ফনের নাড়ির গতি ক্রমেই নিম্নমুখী করতে থাকে। নব্বইয়ের দশকে আইসিইউ’র রোগীর মতো হয়ে পড়লো ঝরনা কলম খাত। ১৯৮২ সালে বিসিক প্রতিবেদনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কলম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একটা সংখ্যা দেওয়া হয়। যেখানে দেখা যায় ফাউন্টেন ও বলপেন মিলিয়ে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। ১৯৯৩ সাল নাগাদ বিসিকের তালিকায় ঢাকায় ১০, নারায়ণগঞ্জে ৩ ও যশোরে ১টি কলম কোম্পানির উল্লেখ পাওয়া যায়। বছর দশেক পর প্রকাশিত আরেকটি জরিপ থেকে জানা যায়, ফাউন্টেন পেন হিসেবে স্বতন্ত্র খাতটি আর নেই, বরং এই খাতকে Pen and Office Articles খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে সারা দেশে ২৯টি প্রতিষ্ঠানে বলপেন আর অফিস ব্যবহার্য উপকরণ তৈরি হয়।

বিলুপ্ত সংগঠন ‘ফাউন্টেন পেন প্রস্তুতকারক সমিতি’র সদস্য ও বেলা পেন কোম্পানির মালিক আবদুল ওয়াহেদের মতে, বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল এই শিল্পটি। ১৯৯০ সালের আগে-পরে কিছু ফাউন্টেন পেন রপ্তানিও হয়েছে। সম্ভবত ১৯৯৮ সালের পরপর ফাউন্টেন পেন বানানো বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও পরোক্ষভাবে এর ব্যবসা চালু ছিল কিছুকাল। কেউ কেউ কলমের পাশাপাশি অন্য ব্যবসাও খুলে বসেছিলেন। বলা যায়, তখনও যন্ত্রপাতিগুলো টিকে ছিল, তারপর উদ্যোক্তার অস্তিত্বের বিলোপ রুখতে এই খাতের পুঁজি অন্য খাতে তার পথ খুঁজে নেয়।

( লেখকের প্রকাশিতব্য বই ‘ফাউন্টেন পেন’ থেকে সংক্ষেপিত)

লেখক: লেখক, গবেষক ও সংগ্রাহক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত