Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

মানবদেহে শূকরের কিডনি : অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ভবিষ্যৎ কি এখানেই

গত ১৬ মার্চ চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে স্লেম্যানের দেহে শূকরের কিডনিটি প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকেরা। ছবি : এএফপি
গত ১৬ মার্চ চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে স্লেম্যানের দেহে শূকরের কিডনিটি প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকেরা। ছবি : এএফপি

জিনগত পরিবর্তন ঘটানো শূকরের কিডনি নিজ দেহে প্রতিস্থাপন করা রিচার্ড স্লেম্যান গত ৩ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তিনিই প্রথম জীবিত মানুষ, যার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে শূকরের কিডনি।

শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ৬২ বছর বয়সী স্লেম্যান চূড়ান্ত পর্যায়ের কিডনি রোগে ভুগছিলেন এবং তার নিয়মিত ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের বস্টন শহরে অবস্থিত হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হাসপাতাল ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে (এমজিএইচ) করা যুগান্তকারী সেই অস্ত্রোপচারের পর তার আর ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হচ্ছে না।

প্রথম শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন কেমন হলো

স্লেম্যানের কিডনি রোগ ধরা পড়েছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে, যার অর্থ হলো– তার কিডনিগুলো আর নিজে থেকে কাজ করছিল না। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি ডায়ালাইসিসের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ২০১৮ সালে এমজিএইচেই এক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল তার দেহে।

কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর পর প্রতিস্থাপিত কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয় এবং ২০২৩ সালের মে মাসে স্লেম্যানকে আবার ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। এরপর থেকে ডায়ালাইসিস রোগীদের মাঝে সাধারণত যেসব জটিলতা দেখা যায়, তার মধ্যেও সেসব জটিলতা দেখা দিতে শুরু করে। ফলে তাকে নিয়মিত হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি শুরু করতে হয়, যার কারণে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

জিনগত পরিবর্তন ঘটানো শূকরের যে কিডনিটি স্লেম্যানের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, সেটি সরবরাহ করেছে ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজের জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি ‘ইজেনেসিস’, যারা মানবদেহের উপযোগী কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির কাজ করে। কোম্পানিটি জিন সম্পাদনার মাধ্যমে কিডনি দাতা শূকরের ক্ষতিকর ডিএনএ অপসারণ করে তার জায়গায় মানবদেহের ডিএনএ সংযোজন করে, যাতে তার কিডনিটি মানবদেহের জন্য আরও উপযোগী হয়ে ওঠে।

গত ১৬ মার্চ চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে স্লেম্যানের দেহে শূকরের কিডনিটি লাগানো হয় এবং অস্ত্রোপচারের মাত্র দুই সপ্তাহ পরই তিনি বাড়ি ফেরার মতো সুস্থ হয়ে ওঠেন।

গত ৩ এপ্রিল হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফেরার মুহূর্তটিকে স্লেম্যান তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেন।

গত ৩ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেলেন রিচার্ড স্লেম্যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত ছবি

স্লেম্যানের দেহে যে পদ্ধতিতে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তা ‘জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন’ এর একটি উদাহরণ। এই পদ্ধতিতে এক প্রজাতির প্রাণীর অঙ্গ আরেক প্রজাতির প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়।

স্লেম্যানের দেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন নিয়েই করা হয়।

স্লেম্যান বলেন, “আমার গল্প দেখে শুভেচ্ছা জানানো সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, বিশেষ করে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ রোগীদের। আজকের দিনটি কেবল আমার জন্য নয়, তাদের জন্যও এক নতুন দিগন্তের সূচনা।”

এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমজিএইচের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “এই পদ্ধতি রোগীদের আরও সহজে অঙ্গ সরবরাহ করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে।”

যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বজুড়ে মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গের যে সংকট বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সাফল্য নতুন আশা দেখাচ্ছে।

অর্গান প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টেশন নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এ মুহূর্তে ১ লাখ ৩ হাজারের বেশি রোগী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় আছে। নেটওয়ার্কের তথ্য আরও বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকা ১৭ জন রোগী মারা যায়।

স্লেম্যানের দেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানকারী এমজিএইচের কিডনি প্রতিস্থাপন বিভাগের পরিচালক লিওনার্দো ভি রিয়েল্লা বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জোনোট্রান্সপ্লান্টেশন অঙ্গের অভাবজনিত সংকটের সম্ভাবনাময় সমাধান হতে পারে।”

জোনোট্রান্সপ্লান্টেশন অঙ্গের অভাবজনিত সংকটের সম্ভাবনাময় সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জাতীয় অঙ্গ প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা পরিচালনায় যুক্ত অলাভজনক সংস্থা ইউনাইটেড নেটওয়ার্ক ফর অর্গান শেয়ারিং (ইউএনওএস)-এর প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডেভিড ক্লাসেন বলেন, “যদিও এখনও অনেক কাজ বাকি, তবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার জন্যই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, যা জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের একটি বাস্তব সম্ভাবনার কথা বলে। এটি একদিন অসংখ্য রোগীর উপকারে আসবে।”

তিনি আরও বলেন, এটি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং প্রতিস্থাপনের জন্য বিদ্যমান অঙ্গের সংখ্যায় যে বড় ব্যবধান রয়েছে, তা কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন কি সাধারণ ঘটনা হতে চলেছে

শূকর বা অন্য প্রাণীর অঙ্গ মানবদেহে ব্যাপক হারে প্রতিস্থাপন শুরুর আগে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডেভিড বেনেট নামে একজন আমেরিকানের দেহে জিনগত পরিবর্তন ঘটানো একটি শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়, যা তার শরীরে কার্যকর বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল তখন। তবে ওই বছরের মার্চে বেনেট মারা যান। তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে লরেন্স ফসেট নামে একজনের দেহে জিনগত পরিবর্তন ঘটানো একটি শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে ছয় সপ্তাহ পরে তিনিও মারা যান।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লরেন্স ফসেটের দেহে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর হাসপাতালের এক বিবৃতিতে বলা হয়, লরেন্সের শরীর প্রতিস্থাপিত হৃৎপিণ্ডটি প্রত্যাখ্যান করছে, এমন লক্ষণ তারা দেখতে পেয়েছিলেন।

তবে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেই নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোন হেলথের সার্জনরা দাবি করেন, ব্রেইন-ডেড একজনের দেহে জিনগত পরিবর্তন ঘটানো একটি শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের পর তা স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছে।

ইউএনওএসের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ক্লাসেন বলেন, “অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি থাকে।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্লাসেন বলেন, প্রত্যাখ্যান একটি সাধারণ ঘটনা এবং প্রতিস্থাপিত অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের লক্ষণগুলোর চিকিৎসা অঙ্গ প্রতিস্থাপনজনিত ওষুধ সমন্বয়ের মাধ্যমে করা হয়।

“সাম্প্রতিক জেনোট্রান্সপ্লান্টের ঘটনাগুলো দেখিয়েছে যে, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা জিনগত পরিবর্তন ঘটানো শূকরের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর তাৎক্ষণিক তা মানবদেহ কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন।”

এই পদ্ধতিটি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কয়েক দশকের গবেষণার ফল বলেও উল্লেখ করেন ইউএনওএসের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা।

“তবে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়ার আগে আরও অনেক কিছু করার আছে, যেমন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যার মাধ্যমে বৃহৎ সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো এবং দীর্ঘমেয়াদে এর ফল নিয়ে গবেষণা করা,” বলেন ক্লাসেন।

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত