উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল।
এর আগে প্লাবিত হয়ে পড়ে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলা। হঠাৎ আসা বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে তিন লক্ষাধিক মানুষ।
সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ জায়গায় নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে ঢুকছে পানি। এছাড়া অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় নদী উপচে পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। এতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।
আকষ্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক, সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক, সারিঘাট-গোয়াইনঘাট সড়ক, দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক, কানাইঘাট বোরহান উদ্দিন সড়কের বিভিন্ন অংশ। এছাড়া উপজেলার অভ্যন্তরীণ প্রায় সব সড়কও পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। এতে বিভিন্ন সড়কে বন্ধ রয়েছে সরাসরি যান চলাচল। সিলেটে মোট ১৩টি উপজেলা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের টিম কাজ করছে। কিন্তু প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙা বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না।”
কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করলেও এখন পর্যন্ত সুরমা নদীর কোথাও ভাঙনের খবর পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
বন্যায় উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানান গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বন্যায় পানিবন্দী হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে। উপজেলার ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ২৫০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে পার্শ্ববর্তী উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে।”
উপজেলার সব নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে জানিয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, “কোথাও কোথাও মানুষের বাড়ির চাল পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। উপজেলায় ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।”
বন্যা পরিস্থিতিতে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটে কোম্পানীগঞ্জের সব পর্যটন স্পট।
সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে শুরু হওয়া অবিরাম বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি বুধবার সকাল থেকেই ছিল বিপৎসীমার ওপরে। বুধবার রাতে ভারতের মেঘালয় থেকে আরও ঢল নামতে শুরু করায় পানি দ্রুত বাড়তে থাকে। বুধবার রাতে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৪-৫টি স্থানে কুশিয়ারা নদীর ডাইক (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) ভেঙে প্রবল বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫৪ সেন্টিমিটার ওপরে ও কুশিয়ারা নদীর পানি শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় সারি নদী সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং গোয়াইনঘাট উপজেলায় সারিগোয়াইন নদী গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানান, গত সোমবার সিলেটে ২৪৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, মঙ্গলবার ১৪৬ দশমিক ১ মিলিমিটার এবং বুধবার ২৪ ঘণ্টায় ১৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
চলতি মৌসুমে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সালে মে মাসে সিলেটে রেকর্ড করা বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৮৩৯ মিলিমিটার, ২০২৩ সালের মে মাসে ছিল ৩৩০ মিলিমিটার এবং ২০২৪ মে মাসের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রেকর্ড করা বৃষ্টির পারিমাণ ৭০৫ মিলিমিটার।
যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ১৩১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২ লাখ ২০ হাজার এন্টিভেনম ইনজেকশন, পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন ও কলেরা স্যালাইন মজুদ রয়েছে।”
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসনও। জনগণের আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেলা ও উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রয়োজনে উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেবে সেনাবাহিনী।”
সিলেটের পাঁচ উপজেলায় মোট ৪৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ২০০ প্যাকেট করে ১০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ৫০ হাজার করে আড়াই লাখ নগদ টাকা ৫ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনূকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান মোবারক হোসেন।