চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচল ১ সেপ্টেম্বর বন্ধ করল দুবাইভিত্তিক বিমান সংস্থা ফ্লাই দুবাই। বন্ধ হওয়ার আগে সংস্থাটি চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন একটি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। এই বিমান সংস্থা দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া সহজ ছিল; একইসঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর ওমরাহ যাত্রী এই ফ্লাইটে যেতো।
এই রুটে হঠাৎ করেই ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে এভিয়েশন সেক্টরে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের এই রুটে বাংলাদেশ থেকে এখনও সবেচেয়ে বেশি যাত্রী রয়েছে। আর এমিরেটস এয়ারলাইনসের কোড শেয়ারিং আছে ফ্লাই দুবাইয়ের সঙ্গে। চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাই দুবাইয়ের টিকেট কিনে বিশ্বের যেকোনো গন্তব্যে এমিরেটস এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করা যায়। চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট বন্ধ করায় যাত্রীরা সেই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
যদিও বন্ধ করার কারণ হিসেবে বিমান সংস্থাটি উড়োজাহাজ সংকটকে দায়ী করেছে। তারা বলছে, সাময়িক সময়ের জন্য ফ্লাইট বন্ধ থাকছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করলেও ঢাকা থেকে ঠিকই ফ্লাইট চলাচল চালু রেখেছে বিমান সংস্থাটি। ফলে উড়োজাহাজ সংকটই বন্ধ হওয়ার মূল কারণ নয়।
তাহলে কি যাত্রী সংকট আছে এই রুটে? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’, কিছুটা আছে। কিন্তু ফ্লাইট বন্ধ করার মতো যাত্রী সংকট তৈরি হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে দুবাই, আবুধাবি এবং শারজাহ রুটে তিনটি বিমান সংস্থা যাত্রী পরিবহন করছে। তারা কেউই ফ্লাইট কমায়নি কিংবা যাত্রা বন্ধ করেনি। উল্টো নতুন করে ফ্লাইট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
এ বিষয়ে এভিয়েশন সেক্টরের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ফ্লাই দুবাই সংস্থার চট্টগ্রামে অপারেশন বন্ধের মূল কারণ জানা গেছে। সেটি হচ্ছে, ফ্লাই দুবাইয়ের গ্রাউন্ড সেলস এজেন্ট (জিএসএ) সংক্রান্ত জটিলতা। বাংলাদেশে ফ্লাই দুবাইয়ের জিএসএ হচ্ছে স্কাই এভিয়েশন সার্ভিসেস লিমিটেড। সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফ্লাই দুবাই কর্তৃপক্ষের বনিবনা না হওয়া।
এক বিদেশি বিমান সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিএসএ পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমান জিএসএ আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন এক শীর্ষ মন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়েই বাংলাদেশ কাজ শুরু করেছিল। নতুন প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না। ফ্লাই দুবাই চাইছে নতুন জিএসএ দিয়ে বাংলাদেশে কাজ শুরু করতে। এ জন্যই শুধু চট্টগ্রাম থেকেই ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে পুরোপুরি বন্ধ থাকলে পুণরায় কার্যক্রম শুরু করে বাজার ধরতে বেগ পেতে হবে বলেই সাময়িক এই উদ্যোগ।”
ওই কর্মকর্তার মতে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ফ্লাই দুবাই চট্টগ্রামের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে নতুন জিএসএ নিয়োগ হলে পুণরায় কার্যক্রম শুরু হবে। আর উড়োজাহাজ সংকট একটি অজুহাত মাত্র।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এক এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জুলাইয়ের মধ্যভাগ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী যাওয়ার হার কমেছে। সেইসঙ্গে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগস্ট থেকে সংযুক্ত আরব-আমিরাতে ভিসা দেওয়া বন্ধ আছে। এতে করে যাত্রী সংখ্যা কমেছে, কিন্তু ফ্লাইট বন্ধের মতো অবস্থা তৈরি হয়নি।”
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের হিসাবে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দিনে গড়ে ২,৬৫৮ জন আন্তর্জাতিক যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন। তবে জুলাই আগস্ট মাসে সেই সংখ্যা কত কমেছে, তার হিসাব এখনও কষেনি কর্তৃপক্ষ।
ঠিক কী কারণে ফ্লাই দুবাই চট্টগ্রামের কার্যক্রম বন্ধ হলো, তা জানতে গত দুদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামের প্রধান মারিয়াম সুলতানাকে ফোন দেওয়া হয়। এরপর টেক্সট পাঠানো হলে তিনি সাড়া দেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে চট্টগ্রামে বন্ধের কারণ হিসেবে ফ্লাই দুবাই চট্টগ্রামের ম্যানেজার (সেলস) মো. মোরশেদ আলম বলেছিলেন, “কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ সেপ্টেম্বর থেকে চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাই দুবাইয়ের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রয়েছে। তবে ঢাকা থেকে যথারীতি ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে। নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হলে আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী।”
চট্টগ্রাম থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন শহরে এতদিন চারটি দেশি-বিদেশি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করতো। ফ্লাই দুবাই বন্ধ হওয়ায় এয়ারলাইনসের সংখ্যা কমে তিনটিতে নেমেছে। সেগুলো হলো- শারজাহভিত্তিক বিমান সংস্থা এয়ার এরাবিয়া। বাংলাদেশি সরকারি বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান এবং বাংলাদেশি বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস। ফ্লাই দুবাই বন্ধের পর সেই যাত্রী এখন অন্য বিমান সংস্থাগুলো পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে আবুধাবি এবং চট্টগ্রাম শারজাহ রুটে দিনে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে এয়ার এরাবিয়া। তাদের প্রতিটি ফ্লাইট যাত্রীসক্ষমতার ৯৫ শতাংশ নিয়ে প্রতিদিন উড়াল দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন এয়ারলাইনসটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই রুটে যাত্রীর কমতি নেই। প্রথমত, অনয়ার্ড প্যাসেঞ্জার অর্থাৎ আবুধাবি, শারজাহ হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া যাচ্ছে। আবার তুলনামূলক কম খরচে বিপুল ওমরাহ যাত্রী এই রুট ব্যবহার করছে। এই অবস্থায় আমরা ফ্লাইট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।”
ফ্লাই দুবাই বন্ধ করায় এই রুটে অন্য বিমানসংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই ভাড়া ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওমরাহ মৌসুম পুরোদমে শুরু হলে ভাড়া আরও বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা ট্রাভেল এজেন্টগুলোর।
হজ্জ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) চট্টগ্রাম জোনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা কমে গেলে ভাড়া বাড়বেই। ফ্লাই দুবাই বন্ধের পর এই রুটগুলোতে আগের তুলনায় ভাড়া ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। শ্রমিক কর্মী যারা কাজ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন, তাদের জন্য একইসঙ্গে ওমরাহ যাত্রীদের এই বাড়তি ভাড়ার বোঝা বইতে হচ্ছে।”
আর চট্টগ্রাম থেকে দুবাই রুটে একটি এবং আবুধাবি রুটে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশ বিমান। আর চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি দুবাই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস। এই দুটি সংস্থা ভালো যাত্রী পেলে ফ্লাই দুবাইয়ের যাত্রী লুফে নিতে তারা ভাড়া কমায়নি।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ৪ লাখ ৭৮ হাজার আন্তর্জাতিক যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে। আর আভ্যন্তরীণ যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে ৩ লাখ ৬ হাজার জন। আন্তির্জাতিক যাত্রীদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন দেশের।