Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

খাদ্যে মূল্যস্ফীতি শহরে ১৪ শতাংশ ছাড়াল

নভেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা শহরাঞ্চলেই লেগেছে বেশি। ফাইল ছবি/সকাল সন্ধ্যা
নভেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা শহরাঞ্চলেই লেগেছে বেশি। ফাইল ছবি/সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

দেশে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে গত নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির এই ধাক্কা শহরাঞ্চলেই লেগেছে বেশি।  

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে শহরাঞ্চলে এই হার ছিল ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একইসময়ে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।

অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে দেশের শহরাঞ্চলে যে খাদ্যপণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, সেই একই পণ্য কিনতে গত মাসে খরচ করতে হয়েছে ১১৪ টাকা ৬৩ পয়সা। আর গ্রামাঞ্চলে সেই পণ্য কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।

আগের মাস অক্টোবরে দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ বা সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ সার্বিকভাবে গত বছরের নভেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় কেন যেত, এই নভেম্বরে তা পেতে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে।

তার আগের মাস অক্টোবরে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৫১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।

নভেম্বর মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও আগের মাসের তুলনায় বেড়ে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে মজুরির হার সামান্য বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবর মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ।

এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছিল বাংলাদেশ। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আগস্টে অবশ্য সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে।

বিবিএসের মূল্যসস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এই প্রশ্ন বার বার তুলেছেন তারা।

দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ বলেছেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে বাস্তবে তা আরও বেশি। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে বাজারের জিনিসপত্রের দামের বাস্তব প্রতিফলন নেই।

একই কথা বলেছে দেশের অর্থনীতির হালচাল জানার জন্য গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটির হিসাবে দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার এখন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও খসড়া হিসাবের ভিত্তিতে তারা এই পরিসংখ্যান দিয়েছে।

এ পদ্ধতিতে শ্বেতপত্র কমিটির হিসাব, চলতি বছরের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ, মে মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, জুনে ১৫ শতাংশ, জুলাইয়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, আগস্টে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

দরিদ্র মানুষের জীবনে এর চরম অভিঘাত পড়ছে। বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি।

২০২৪ সালে সরকারি সংস্থা বিআইডিএস ও ২০২২-২৩ সালে সানেমের জরিপেও এই বিষয়ের সত্যতা উঠে এসেছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক বেশি। এতে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারেও প্রভাব পড়েছে।

তবে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান যে ইচ্ছাকৃতভাবেই কম করে দেখানো হতো, বিষয়টি সে রকম না-ও হতে পারে। বিষয়টি সম্পর্কে তারা পরিষ্কারভাবে কিছু বলেনি। বিবিএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শ্বেতপত্র কমিটির মনে হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির অদৃশ্য উচ্চসীমা ছিল ১০ শতাংশ, এটা মনে করা ভিত্তিহীন নয়। এ ছাড়া পদ্ধতিগত সমস্যা তো আছেই।

দেশে যে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তার পক্ষে বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, সেই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। যদিও সেই মাসে বিবিএসের হিসাব ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বেশ কিছু নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের গ্রামাঞ্চলের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও এই সময় সরকারি হিসাব হচ্ছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মের ব্যানারে গত জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। পরে জনতাও অংশ নেয়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি, যাতে অচল হয়ে পড়ে দেশ। ভেঙে পড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশের বাজার ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হয়, যার কারণে আরও বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে পরিস্থিতি, স্থিতিশীল হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা।

মজুরি সূচক ৮.১০ শতাংশ

মানুষের আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস।

মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, গত দুই বছর ধরে মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশে ওঠে। এভাবে প্রতি মাসেই অল্প অল্প করে বেড়ে অক্টোবরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে ৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ হয়। নভেম্বরে আরও কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত