“একটু ভালো করে বাঁচবো বলে আর একটু বেশি রোজগার,
ছাড়লাম ঘর আমি, ছাড়লাম ভালোবাসা
আমার নীলচে পাহাড়…।”
অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গানের মতোই একে একে হিমালয়ের নীলচে পাহাড় ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন নেপালের ফুটবলাররা।
নেপাল জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক সুজাল শ্রেষ্ঠা, ডিফেন্ডার রঞ্জিত ধীমাল, বিকাশ খাওয়াজ, রঞ্জন বিসতা, মিডফিল্ডার বিশাল রায়, বিমল ঘাটতি মাগার, দীনেশ রাজবংশী, সুমন আরিয়াল, মিকচেন তামাং, হেমন্ত থাপা মাগার, নীতিন থাপা, তেজ তামাং, অভিষেক রিজাল, দীপক সিং ঠাকুরি, বিমল রানা, রেজিন সুব্বাহ, পুজান উপারকতি, নিশান খাড়কা, রবি পাসওনসহ ৫০ ফুটবলার বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। নেপাল জাতীয় দলে সাকুল্যে সিনিয়র ফুটবলার আছেন মাত্র ৩ জন-গোলরক্ষক কিরণ লিম্বু, অঞ্জন বিসতা ও অনন্ত তামাং।
২০২৩ সালে ‘এ’ ডিভিশনে ওঠা ক্লাব চার্চ বয়েজের সঙ্গে চুক্তি করেন ডিফেন্ডার দীনেশ রাজবংশী ও মিডফিল্ডার তেজ তামাং। দুজনই এক সময় বড় স্বপ্ন দেখতেন নেপালের ফুটবল নিয়ে। পাঁচ বছর ধরে জাতৗয় দলে নিয়মিত মুখ দীনেশ ও তেজ তামাং। এই দুজনকে দলে নাম লিখিয়ে লিগে বড় সাফল্য পেতে চেয়েছিল চার্চ বয়েজ।
দুই ফুটবলারই এর আগে খেলতেন নেপালের অন্যতম বিখ্যাত ক্লাব মানাং মার্সিয়াংদিতে। দুজনের বেতন ছিল মাসে ১ লাখ নেপালি রুপি করে। কিন্তু চার্চ বয়েজ যখন ঘোষণা দিল পরের মৌসুমে দীনেশ ও তেজ খেলবে তাদের ক্লাবে, কিছুদিনের মধ্যে দু জনই অস্ট্রেলিয়ার বিমানে চেপে বসেন।
একই দিনে ডিফেন্ডার গৌতম শ্রেষ্ঠাও অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে কাঠমান্ডু ছাড়েন। এর কিছুদিন বাদে মিডফিল্ডার নিতিন থাপা ও স্ট্রাইকার অঞ্জন বিসতাও নেপাল ছাড়েন। অথচ নিতিন সানকাতা ক্লাবে, হেমন্ত খুমাতলা ক্লাবে ও অঞ্জন নিউ রোড ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেছিলেন।
২০১৬ সালে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে ছিলেন জগজিত শ্রেষ্ঠা। ওই সময় তিনি নেপাল ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। তার দেখাদেখি সুলাম মাসকে, হেমান গুরুং ও অ্যালান নিউপানেও পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। যখন এই ফুটবলাররা অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ উপার্জন শুরু করেন, তাদের দেখাদেখি আরও অনেকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
২০১৯ সালে নেপাল এসএ গেমসে ফুটবলের পুরুষ বিভাগে সোনা জিতেছিল। অবাক হলেও সত্যি, ওই সোনাজয়ী দলের ৮ ফুটবলার বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া থাকেন।
অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন সুমন লামা, আশিষ লামা, দর্শন গুরুং ও সাজগ রায়। এর মধ্যে দর্শনকে নেপালের সবচেয়ে উদীয়মান প্রতিভা ভাবা হচ্ছিল।
২০২২ সালে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে কুয়েতের বিপক্ষে যোগ হওয়া সময়ে গোল করেছিলেন এই তরুণ ফরোয়ার্ড। যেটা নেপালের ফুটবলের ইতিহাসে অনেক বড় কীর্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ৪০ বছর পর নেপালের কোনও ফুটবলার কুয়েতের জালে বল জড়িয়েছিলেন। সর্বশেষ ১৯৮২ সালে নেপাল কুয়েতকে একটি গোল দিয়েছিল। দিল্লিতে এশিয়ান গেমসের ওই ম্যাচে ওয়াই বি ঘালে করেন সেই গোল।
২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক হয় সুমন লামার। তিনি নেপালের জার্সিতে খেলেছেন ২২ ম্যাচ। আরিয়ালের অভিষেক হয়েছে ২০১৮ সালে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। দীনেশ রাজবংশির ইয়েমেনের বিপক্ষে অভিষেক, ২৪ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। অভিষেক রিজালের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। ১২ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। এছাড়া তেজ তামাং ২৪ ম্যাচ, সন্তোষ তামাং ১৬ ম্যাচ ও আশিষ লামা ৬ ম্যাচ নেপালের হয়ে খেলেছেন। নেপালের সাবেক কোচ আবদল্লাহ আল মুতাইরি তার দুই বছরের মেয়াদে ২০ ম্যাচে ১৫ নতুন ফুটবলারকে অভিষেক ঘটান।
এর মধ্যে গৌতম শ্রেষ্ঠা, আকাশ বুদ্ধ মাগার, শিবা গুরুংও এই কোচের অধীনে খেলেছেন নেপালের জার্সিতে। কিন্তু নেপালের ফুটবলে ভবিষ্যত দেখতে না পেয়ে তারা সবাই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন।
এভাবে নেপালি ফুটবলারদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, যা নেপাল ফুটবলের জন্য বড় অশনি সঙ্কেত।
নেপালের সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক ও কাঠমান্ডু পোস্টের সাবেক সাংবাদিক প্রজ্জ্বল ওলি বলেছেন, “ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা ফুটবলাররা এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাটা সত্যি হতাশাজনক। এতে দিন শেষে ক্ষতি হচ্ছে নেপালের ফুটবলের। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দেশ ছাড়ায় আমাদের আন্তর্জাতিক ফুটবলে তৈরি হচ্ছে বিশাল শূন্যতা।”
নিয়মিত ফুটবল লিগ নেই নেপালে
নেপালে নিয়মিত আয়োজন করা হয় না ফুটবল লিগ। সর্বশেষ লিগ হয়েছিল ২০২১ সালে। তাছাড়া নেপালের ঘরোয়া ফুটবলে পারিশ্রমিকও তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। এর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়ে অনেকে নেপালের তুলনায় ৪-৫ গুণ রুপি উপার্জন করছেন ফুটবলাররা। ফুটবলারদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার পেছনে এটা বড় কারণ।
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও নেই, খ্যাপ খেলেন ফুটবলাররা
নেপালে ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল লিগও আগের মতো আয়োজন করেনা আনফা। অথচ ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের এক মৌসুমেই লিগের চেয়ে প্রচুর আয় হতো আগে। একজন ফুটবলার এমনও হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ লাখ রুপি উপার্জন করেছেন।
ফুটবল লিগ মৌসুমও খুব অল্প সময়ের জন্য হয় নেপালে। মাত্র ৩-৪ মাসেই শেষ হয়ে যায় লিগ। এ কারণে আয় কম। বাকি সময়ে খ্যাপ খেলে সংসার চালাতে হয় নেপালি ফুটবলারদের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ বছরে নেপালি ফুটবলাররা মাত্র ১০ মাস ফুটবলে ব্যস্ত ছিল! এর মানে ফুটবলাররা মাত্র ১০ মাস অর্থ আয়ের সুযোগ পেয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার ভিসা নীতি ফুটবলারদের পক্ষে
বেশিরভাগ নেপালি ফুটবলার অস্থায়ী ওয়ার্কিং ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান। যারা এই ভিসায় যান তারা ওই নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারেন না। যদিও অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন পলিসি অনুসারে যারা এভাবে যায় তারা পরবর্তীতে ভিসা বদল করে ছাত্র ভিসা পেয়ে যান। যদি ছাত্র ভিসায় তারা তাদের পড়াশুনার কোর্স শেষ করে তখন স্থায়ী ভিসাও পেয়ে যান। এরপর চাইলে ফুটবলও খেলতে পারেন। এভাবে নেপালের অনেকেই ইদানিং বিভিন্ন অস্ট্রেলিয়ান ক্লাবে ফুটবল খেলছেন। নেপালি কমিউনিটির বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও খ্যাপ খেলে বেড়াচ্ছেন তারা ওখানে।
হতাশ আনফা
নেপালি ফুটবলারদের দেশ ছেড়ে যাওয়া কিছুতেই থামাতে পারছে না অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আনফা)। এসব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ও সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনাও নেই আনফার। এমনকি এ পর্যন্ত কত জন ফুটবলার খেলা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্যও নেই তাদের।
অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আনফা) মুখপাত্র সুরেশ সাহা সকাল সন্ধ্যাকে অসহায়ের সুরে জানালেন, “এটা সত্যি যে এই ফুটবলাররা চাইলে অন্যভাবেও তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারতো। কিন্তু তারা এ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। এটা খুব দুঃখজনক। আমরা তো বিমান বন্দরে গিয়ে আটকাতে পারব না তাদের।”
এতকিছুর পরও এই ফুটবল কর্মকর্তা তাদের জন্য জাতীয় দলের দুয়ার খুলে রাখতে চান, “ওরা কিন্তু পুরোপুরি ফুটবল ছেড়ে দেয়নি। উইক এন্ডে অস্ট্রেলিয়ায় নেপালি কমিউনিটি প্রচুর ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ওরা খেলছে বলে জানি। আমরা প্রতিনিয়ত এসব ফুটবলারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এবং প্রয়োজনে তাদের ফিরিয়ে এনে জাতীয় দলে খেলানোর সুযোগ করে দেব।”