বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে বলে স্বীকার করলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। আর সেটা মেনে নিয়েই দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে জোর দিলেন তিনি।
শনিবার ঢাকায় বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : প্রত্যাশা, প্রতিবন্ধকতা এবং ভবিষৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন উপদেষ্টা।
৫ আগস্ট পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এক রকম সম্পর্ক ছিল, ওইদিনের পর সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে একথা উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, “এই বাস্তবতার নিরিখেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণ করতে হবে এবং তা চালিয়ে যেতে হবে।
“আমার বিশ্বাস ভারতও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নিতে হবে সেটা উপলব্ধি করবে, হয়তো করছেও। তারা সেই অনুযায়ী এগুবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।”
আগের সরকার ভারতের স্বার্থগুলো দূর করার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের স্বার্থগুলো আদায়ে যথাযথভাবে ব্যবস্থা নেয়নি বলে মনে করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তার মতে, এ কারণেই দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে এখন এক ধরনের দোলাচল তৈরি হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে এবং এতে দুই দেশের স্বার্থই সংরক্ষিত হবে, প্রত্যাশা তার।
প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে বিস্তৃত। তা সে রাজনৈতিক হোক আর বাণিজ্যিক। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বহু চুক্তি সই হয়েছে, বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ভারতের এক অংশের পণ্য অন্য অংশে নেওয়ার মতো চুক্তি বাস্তবায়িতও হয়েছে।
বরাবরই আওয়ামী লীগের বিরোধী দলগুলো তুলেছে চুক্তিতে অসমতার অভিযোগ। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয় না, এ অভিযোগও নতুন নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেই থেকে তিনি ভারতেই রয়েছেন।
তার অবস্থান নিয়ে শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়।
গোলটেবিলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “পূর্ববর্তী সরকার ভারতের যেগুলো কনসার্ন ছিল, উদ্বেগ ছিল সেগুলো দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমাদেরও কিছু কনসার্ন ছিল, আছে। যদি আমাদের কনসার্নগুলো ঠিকমত মিট করা হতো তাহলে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে যে দোলাচল সেটা থাকত না। মোটাদাগে আমাদের যেগুলো কনসার্ন ছিল সেগুলোর বিষয়ে ঠিক ওইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণেই যে সমস্যা হয়েছে।”
তবে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক সব সময় একরকম যাবে, এমন কোনও কথা নেই বলেও মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “আমরা একটা ভালো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারব, যাতে করে দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটি যে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এমন হবে, যেন উভয় দেশেরই স্বার্থ সংরক্ষিত হয়, সেটা যেন একদিকে না যায়।”
ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে উল্লেখ করে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “সামনে আমরা যেসব প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই, যেটি নিয়ে এই মুহূর্তে কাজও হচ্ছে, যেমন পানি সমস্যা। তিস্তা নিয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি, আমরা চাইব অগ্রগতি হোক।”
এছাড়া সীমান্তে হত্যা বন্ধের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “পৃথিবীর একমাত্র সীমান্ত, যে দুটি দেশ যুদ্ধরত না, অথচ যেখানে মানুষকে গুলি করে মারা হয়। পৃথিবীতে আর কোথাও এটা নেই। এটা ভারতকে দেখতে হবে। এটা সহজে দূর করা সম্ভব। আসলে এভাবে গুলি করে মানুষ মারার প্রয়োজন নেই।
“পৃথিবীর সব বর্ডারেই অপরাধ হয়, অপরাধ হলেই গুলি করে মারতে হবে, এমন কথা নেই। আপনি যদি মনে করেন অপরাধ করেছে, আপনি ধরে নিন, আপনার দেশের আইনের সোপর্দ করে বিচার করুন, শাস্তি দিন, কোনও সমস্যা নেই।”
ভাতীয় গণমাধ্যমগুলো হঠাৎ করেই বাংলাদেশকে জড়িয়ে নানা ধরনের মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ করেন উপদেষ্টা। এই মিথ্যাচার বন্ধে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোকে শক্ত হতে আহ্বান জানান তিনি। ভারতের গণমাধ্যমে যে বাংলাদেশকে নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে, তা সবার সামনে তুলে ধরতেও অনুরোধ করেন।
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যমত্য না থাকার কারণে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে আরও অর্জন করতে পারতাম, কিন্তু আমরা পারিনি, শুধুমাত্র জাতীয় ঐক্যমত্য না থাকার কারণে। কোনও দলের কথা বলছি না, দেখা গেছে, সরকারি দল একটা বলেছে, সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দল বিরোধীতা করেছে। দেখা গেছে সেখানে জাতীয় স্বার্থ আছে কিনা তা বিবেচনাতেই নেয়নি। এই জায়গা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেখানে জাতীয় স্বার্থ আছে সেখানে জাতীয় ঐক্যমত্য থাকতে হবে।”
বৈঠকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এস এম আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “চিন্ময় দাশের ব্যাপারে সরকার সঠিক কাজটিই করেছে। চিন্ময় দাশ বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের আইন ভঙ্গ করলে অন্যান্য নাগরিক অপরাধ করলে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, সেই কাজটিই সরকার করেছে।
“এটিকে ধর্মভিত্তিক বিষয় হিসেবে দেখার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ভারতের সমস্যা হচ্ছে, চিন্ময় দাশ আইনি সুবিধা পাবে কিনা পাবে না, এ নিয়ে সরব হয়েছে, বিবৃতি দিয়েছে।”
এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অন্যায়ের শিকার হলেও ভারত কোনও বিবৃতি দেয়নি, এমনকি আওয়ামী লীগের আমলে গুম-খুনের বিষয়েও ভারত প্রতিবাদ জানায়নি; অভিযোগ করেন তিনি।
মানারাত ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব বলেন, “ভারত আগরতলা বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য আমাদের সীমান্তের ভেতরে জায়গা চেয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য। তারা সব সময় নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, আমাদের বিষয় দেখে না।”
বাংলাদেশে ইসলামভিত্তিক যেকোনও বিষয় নিয়ে ভারত সব সময় সোচ্চার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কোনও ঘটনা ঘটলেই তারা পার্লামেন্টে আওয়াজ করে। কিন্তু ভারতেই তো হরদম মসজিদ ভেঙে ফেলছে, গরুর মাংস খাওয়ার ফলে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। তাতে সরকারও সাপোর্ট দিচ্ছে!”