Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

বিদেশি ঋণ পরিশোধে রেকর্ড, চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে

মার্কিন ডলার
[publishpress_authors_box]

বিদেশি ঋণ পরিশোধে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বাংলাদেশ। তা দেখে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে চাপ বাড়বে অর্থনীতিতে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিভিন্ন সময়ে দাতাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ ৩৫০ কোটি ৭২ লাখ (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।

পরিশোধের এই অঙ্ক গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। আর পুরো অর্থ বছরের চেয়ে ৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ বেশি।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছর শেষ হতে এক মাস বাকি থাকতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রথম ১০ মাসের বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি, প্রাপ্তি, ও পরিশোধ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যায়, এই ১০ মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৫১৬ কোটি ৩৪ লাখ (৬.১৬ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।

এই অঙ্ক গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১২ কোটি (১.১২ বিলিয়ন) ডলার কম। শতাংশ হিসাবে কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।

গত অর্থ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে উন্নয়ান সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ৬২৮ কোটি ৪০ লাখ (৬.২৮ বিলিয়ন) পেয়েছিল বাংলাদেশ।

অন্যদিকে গত ১০ মাসে বাংলাদেশকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৫০ কোটি ৭২ লাখ (৩.৫ বিলিয়ন) ডলার; যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

গত অর্থ বছরের একই সময়ে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৮১ কোটি ১৭ লাখ (২.৮১ বিলিয়ন) ডলার। আর অর্থ বছরের পুরো সময়ে ৩৩৭ কোটি (৩.৩৭ বিলিয়ন) ডলার শোধ করেছিল।

হিসাব বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয় বিদেশি ঋণের পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

বিদেশি ঋণ পরিশোধ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি আগেই আঁচ করছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল, বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাবে। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে।

“মূলত বিগত সময়ে নেওয়া বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের বড় অঙ্কের ঋণ ও বাজেট সহায়তার গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে, যা আগামী বছরগুলোয় দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াতে পারে।”

অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১০ মাস পেরুলেও অর্থনীতির আকাশের মেঘ এখনও কাটেনি।

এই মুহূর্তে বিদেশি ঋণ ‘খুবই প্রয়োজন’ বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। আর তিনি চান, তা যেন আসে বাজেট সহায়তা হিসাবে।

কেন? তার ব্যাখ্যায় এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “সরকারের এখন নগদ ডলার দরকার; সেজন্য বাজেট সহায়তার দিকে বেশি জোর দিতে হবে। কেননা, প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশি সহায়তা নিলে প্রকল্পের কেনাকাটার সময় ডলার আসে। এতে অনেক সময় চলে যায়। আর বাজেট–সহায়তার ডলার অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। তাই ডলারের জোগান বাড়াতে বাজেট–সহায়তাই উত্তম পন্থা।”

সেদিকে সরকারের তৎপরতা রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ অন্য উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে বলে শোনা যাচ্ছে।

“দেখা যাক কী হয়,” বলেন জাহিদ হোসেন।  

ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৩৫০ কোটি ৭২ লাখ (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারের যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, তার মধ্যে ২২১ কোটি (২.২১ বিলিয়ন) ডলার শোধ করা হয়েছে আসল বাবদ। আর সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৩০ কোটি (১.৩০ বিলিয়ন) ডলার।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে যে ২৮১ কোটি ১৭ লাখ (২.৮১ বিলিয়ন) ডলার শোধ করা হয়েছিল, তার মধ্যে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার। আসল শোধে গিয়েছিল ১৬৬ কোটি ৩৭ লাখ (১.৬৬ বিলিয়ন) ডলার।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা আছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

টাকার হিসাবে ইআরডি বিদেশি ঋণ পরিশোধের যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের ১০ মাসেই তার ১৬ শতাংশ বেশি (৪২ হাজার ২৮২ কোটি ডলার) চলে গেছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করা হয়।

ডলারের দাম বাড়ায় টাকার অঙ্কে বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ইআরডি’র কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২২ টাকা ৮৬। অর্থাৎ এক ডলারের জন্য ১২২ টাকা ৮৬ খরচ করতে হয়েছে।

এক বছর আগে ২০২৪ সালের ২৩ মে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৭ টাকা ৮২ পয়সা।

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বেড়েছে ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।

১২ বছরে পরিশোধ বেড়েছে তিন গুণ।

বড় বড় প্রকল্পের বিদেশি ঋণ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন কয়েক বছর ধরেই।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।

২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা পৌনে তিনশ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে অঙ্কটি ৩৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হওয়ার পর এবার ১০ মাসেই সাড়ে তিনশ ডলারে উঠেছে।

অর্থাৎ ১২ বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে।

কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। দুই বছর ধরে আরও বেশি বেড়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট চলছে।

বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

২৭.১৮ শতাংশই দিয়েছে এডিবি

ইআরডি’র তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যে ৫১৬ কোটি ৩৪ লাখ (৫.১৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১৪০ কোটি ৩৪ লাখ (১.৪০ বিলিয়ন) ডলারই দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

হিসাব বলছে, এই ১০ মাসে মোট ঋণের ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশই এসেছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থাটি থেকে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৫ কোটি ৮৪ লাখ (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। মোট ঋণের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ দিয়েছে সংস্থাটি।

তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার দিয়েছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। রাশিয়া দিয়েছে ৬৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।

অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে জুলাই-এপ্রিল সময়ে চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৩২ কোটি ৭ লাখ ডলার। ভারত ছাড় করেছে ১৫ কোটি ২২ লাখ ডলার। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।

ইআরডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪২৫ কোটি ৯৪ লাখ (৪.২৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ে ছিল ৭৬০ কোটি ৩৪ লাখ (৭.৬০ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে এই ১০ মাসে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৪৪ শতাংশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত