বাম থেকে ডানের দিকে সরে নিজের রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে যিনি তিন যুগ আগে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন, সুনামগঞ্জের সেই রাজনীতিক নজির হোসেন আর নেই।
তিনি বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকার উত্তরার নিজের বাড়িতে মারা যান বলে জানিয়েছেন তার ছোট ভাই কবি ইকবাল কাগজী।
৭৫ বছর বয়সী নজির হোসেন স্ত্রী, এক দত্তক ছেলে রেখে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজন তাহিরপুরের বিএনপি নেতা ফেরদৌস আহমদ জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় সুনামগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে নজির হোসেনের প্রথম জানাজা এবং বিকাল ৫টায় নিজ গ্রাম শাহপুরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
ছাত্রজীবন থেকে বাম আন্দোলনের কর্মী নজির হোসেন কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির নেতা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে সিপিবি থেকেই সুনামগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোটের প্রার্থী হিসাবে তার প্রতীক ছিল নৌকা।
নজিরসহ সিপিবির পাঁচজন যখন সংসদে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রেক্ষাপটে দলটিতে ভাঙন ধরে। একাংশ সিপিবি নামে থাকলেও আরেক অংশ কামাল হোসেনকে নিয়ে গড়ে তোলেন গণফোরাম নামে নতুন দল। আরেকটি অংশ কমিউনিস্ট কেন্দ্র নামে আরেকটি দল গড়ে। সিপিবির আরও নেতারাও বিভিন্ন দলে ভিড়তে থাকে।
নিজ দলের এই ভাঙাগড়ার মধ্যে নৌকায় ভোট করে জিতে আসা নজির ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর যোগ দেন বিএনপিতে। তখন তার বিএনপিতে যোগদান রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
পরে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সুনামগঞ্জ-১ আসনে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য হন নজির।
তবে জরুরি অবস্থার সময় সংস্কারপন্থি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেয় বিএনপি। ধানের শীষ প্রতীকে ভোটেও দাঁিড়য়েছিলেন তিনি, তবে পরাজিত হন।
নজিরের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামে। ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় নজির ১৯৬৬ সালে সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালের শেষ দিকে সুনামগঞ্জ মহকুমা সিপিবির দায়িত্ব নিয়ে তিনি জন্মস্থানে ফিরে যান। সুনামগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও কৃষক সমিতির সাংগঠনিক অবস্থান তৈরিতে তার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে নজির সুনামগঞ্জ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সহ সম্পাদক নিযুক্ত হন৷ তার উদ্যোগে টেকেরঘাট গেরিলা জোনটি গড়ে ওঠে ৷ ১৯৭১ সালে জুনের প্রথম দিকে ভারতের শিলংয়ে বরুণ রায়, পীর হাবিবুর রহমান, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও আব্দুল লতিফ সরদারের উপস্থিতিতে টেকেরঘাট সাব সেক্টর একটি গেরিলা যুদ্ধের জোন হিসেবে গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতার পর নজির সুনামগঞ্জ মহকুমা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৪ সালে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কাজ করেছিলেন নজির। এরশাদবিরোধী আন্দোলন সংগঠনেও ভূমিকা ছিল তার। তখন কারাগারেও যেতে হয়েছিল তাকে। সুনামগঞ্জে জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্থানীয়ভাবে সংগঠিত ‘ ভাসান পানি আন্দোলনের’ মূল সংগঠক ছিলেন তিনি।
বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পর প্রথমে দলটির সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি হন নজির। সর্বশেষ তিনি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য ছিলেন। বছরখানেক থেকে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিলেন।