দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম উগ্র ডানপন্থী শাসনামলে প্রবেশের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ফ্রান্স। একটা সময় যা ভাবাও অসম্ভব ছিল, এখন তা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে।
ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। অধিকাংশ বুথ ফেরথ জরিপে দেশটির উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) দলের জয়ের বার্তা দেওয়া হয়েছে। একে ফরাসি রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থার উত্থান হিসেবে দেখছে বিশ্লেষকরা।
তবে মারিন লো পেনের দল আরএন শেষমেষ দেশটির পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কি না, এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ জুলাই পর্যন্ত। কারণ সেদিন হবে দ্বিতীয় ধাপের ভোট।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই এক সপ্তাহের মধ্যে ফরাসি রাজনীতির অনেক কিছু নির্ধারিত হবে। মধ্যপন্থী ও বামপন্থীরা জোট বেঁধে আরএন বিরোধী ভোট একাট্টা করার চেষ্টা করতে পারে। তেমনি আরএন নেতৃত্বও ছোট দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে জোট গড়ার পথে হাঁটতে পারে। আর একই সময়ে রিপাবলিকান ফ্রন্টের ভাগ্যও নির্ধারিত হবে।
সোমবার ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রথম ধাপের ভোটে আরএন ও এর মিত্ররা ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর একটি বামপন্থী ব্লক ২৮ শতাংশ ও প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর মধ্যপন্থীরা মাত্র ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
এখন পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে আরএন নিঃসন্দেহে এখন ফ্রান্সের প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তিকে পরাস্ত করতে গেলে বিরাট কোনও ঘটনা বা পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে, লেখা হয়েছে ফল প্রকাশের পর বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
কিন্তু অভিবাসীবিরোধী ও ইউরোসেপটিক আরএন পার্টি সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে কি না, তার জন্য ৭ জুলাই দ্বিতীয় দফার ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অন্য দলগুলো ফ্রান্সজুড়ে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে সমাবেশ করে নিজেদের পক্ষে কতটা ভোট আদায় করতে পারবে, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনী ফলকে ম্যাঁক্রোর জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে হারের পর তিনিই ফ্রান্সে আগাম নির্বাচনের ডাক দেন। তখনই নির্বাচনে ম্যাঁক্রোর জয় পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল।
জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা আর বিভক্ত পার্লামেন্টে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে পার্থক্য আছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরএন পার্লামেন্টের ২৬০ থেকে ৩১০ আসন পেতে পারে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যেহেতু ২৮৯ আসন প্রয়োজন, ফলে এখনও অনেক খেলা বাকি।
ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী ও বামপন্থী নিউ পপুলার ফ্রন্ট জোট তাদের সমর্থকদের ৭ জুলাইয়ের ভোটে কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি যদি তাদের নিজের প্রার্থীও ছিটকে পড়ে, তবু ভোটারদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় আরএন এর বিরুদ্ধে যাকে দাঁড় করানো হবে, তাকেই বেছে নেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।
কিন্তু এমন দলীয় আদেশের সমস্যা হলো, কম সংখ্যক মানুষই এমন আদেশ মেনে চলেন।
একটা সময় ছিল যখন আরএন এর পক্ষে ভোট দেওয়াকে লজ্জা হিসেবে দেখা হত। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। শুধু যে ফ্রান্সেই এমন তা নয়, গোটা ইউরোপেই ডানপন্থার বাড় বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আরএন প্রতিপক্ষদের জন্য আরেকটি প্রতিকূলতা হলো দ্বিতীয় ধাপে তথাকথিত ‘ত্রিভূজাকার ভোটের’ সংখ্যাধিক্য। এমন অনেক আসন আছে যেখানে দ্বিতীয় ধাপে তিনজন প্রার্থী মুখোমুখি হবেন। এক্ষেত্রে একজন মধ্যপন্থী, একজন উগ্র ডানপন্থী ও অন্যজন বামপন্থী প্রার্থী।
ত্রিভূজাকার ভোটের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ হলো উচ্চ ভোটার উপস্থিতি। একে এবারের নির্বাচনের গুরুত্বের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে। আরও একটি কারণ হলো, এবার ছোট রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে প্রচার চালাতে পারেনি।
১৯৯৭ সালের পর থেকে এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি ছিল। এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৪ কোটি ৯০ লাখ।
পর্যবেক্ষকদের মতে, কোনও আসনে তিনটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে আরএন বিরোধী ভোটকে একত্রিত করা কঠিন হবে। অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যপন্থী বা বামপন্থী প্রার্থীরা সরে দাঁড়াবেন। অবশ্য এমনটা যে সব ক্ষেত্রেই হবে তা নয়।
ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচন হয় দুই ধাপে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে কোনও প্রার্থী সরাসরি জয় না পেলে শীর্ষ দুই প্রার্থীর পাশাপাশি ১২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীরা দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।
দ্বিতীয় ধাপে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, তিনিই জয়ী হবেন।
৭ জুলাইয়ের নির্বাচনে সম্ভবত ৩০০ আসনে ত্রিমুখী রান-অফ হতে যাচ্ছে। আর এমনটা হলে এর ইতিবাচক ফল আরএন এর পক্ষেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ত্রিমুখী রাফ-অফ ঠেকাতে ও আরএনকে হারাতে ফ্রান্সের মধ্য-ডান ও মধ্য-বাম রাজনীতিকরা দীর্ঘদিন ধরেই ‘রিপাবলিকান ফ্রন্ট’ কৌশল অবলম্বন করে আসছে। এই কৌশলে তৃতীয় স্থান অধিকারী প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং ভোটারদের দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে ভোট দিতে আহ্বান জানানো হয়।
রান-অফে উত্তীর্ণ সব প্রার্থীকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যাবেন নাকি দ্বিতীয় ধাপে লড়াই করবেন।
বামপন্থী নিউ পপুলার ফ্রন্ট ও ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোটের নেতারা রবিবার রাতে জানিয়েছেন, তারা সেসব জেলা থেকে তাদের নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করবেন যেখানে ৭ জুলাইয়ের ভোটে আরএন’কে পরাজিত করতে অন্য প্রার্থী আরও ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
ম্যাক্রোঁর সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদোয়ার্দ ফিলিপ্পে তার পার্টির সেই প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন, যারা তাদের আসনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। আর ওই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্য-বাম ও মধ্য-ডানপন্থী প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সোশালিস্ট ও বামপন্থী নেতারাও তাদের তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রার্থীদের সরে দাঁড়াতে বলেছেন।
কিন্তু বিষয় হলো রিপাবলিকান ফ্রন্ট গত কয়েক বছর ধরেই বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এখন আর ভোটাররা আগের মতো ফ্রন্টটির উপদেশ শুনতে চান না। ফ্রন্টের নেতাদের নির্দেশনা ভঙ্গ করে অনেক প্রার্থী (তৃতীয় অবস্থান) দ্বিতীয় ধাপে লড়াই করবেন, এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
অবশ্য দ্বিতীয় ধাপের ভোটকে কেন্দ্র করে একাধিক জরিপ বলছে, লো পেনের দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এক্ষেত্রে কোনও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে। আরএন তখন তাদের অভিবাসন, করের হার কমানো ও আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলো পাস করাতে পারবে না।
আরএন জয়ী হলে তারা জ্বালানির বিক্রয় করের ওপর ভ্যাট কমাতে চায়। এই পদক্ষেপে আংশিকভাবে সরকারি অর্থায়নও করতে চায় দলটি। জুলাইয়ের শুরু থেকেই এই পদক্ষেপ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এজন্য ইইউ এর বাজেটে আগের চেয়ে ২০০ কোটি ইউরো কম বরাদ্দ দিতে চায় দলটি।
ডানপন্থীদের জয়জয়কার দেখে প্যারিসের মতো বড় শহরগুলোর মানুষদের মধ্যে হতাশা নেমে আসছে। রবিবার প্যারিসের রাস্তায় বামপন্থী ভোটারদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, ডয়েচে ভেলে