ফ্রান্সের নির্বাচনে উগ্র-ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালির (আরএন) জয়ে ভয় জেঁকে ধরেছে দেশটির মুসলমানদের মনে। অনেকেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কেউ কেউ ফ্রান্স ছাড়ার চিন্তাও করছেন।
মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত আরএন পার্টি অনেকদিন ধরেই ফ্রান্সের হিজাব নিষিদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদ আইনসহ কঠোর অভিবাসন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে। বিতর্কিত এসব বিষয়ে ক্রমশ ফ্রান্সে জনমত বেড়েছে, তার প্রমাণ এনআর পার্টির এই জয়।
ফ্রান্সে আরএন পার্টি সরকার গঠন করবে কি না, তা নিশ্চিত হবে ৭ জুলাইয়ের দ্বিতীয় ধাপের রান-অফ নির্বাচনের পর। দেশটির ক্ষমতাসীন রেঁনেসা পার্টি ও এর মিত্ররা জোর চেষ্টা চালাচ্ছে এনআর পার্টির উত্থান ঠেকাতে।
কিন্তু ফ্রান্সের মুসলিম সম্প্রদায়ের ৬০ লক্ষাধিক মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তাদেরই মধ্যে একজন ২২ বছর বয়সী নারী ফাতিমা। হঠাৎ করেই তিনি অনুভব করতে শুরু করেছেন যে, তার দেশের অনেকেই তার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করছে।
ফাতিমা আল জাজিরাকে বলেন, “ফ্রান্স যে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে- এমন অনুভূতি তীব্র হচ্ছে। পাবলিক স্পেসে হিজাবে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ভোটদানকারী এক কোটি ৬ লাখ মানুষের এই বিশাল সংখ্যা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।”
তিনি সেসব ফরাসি নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের মারিন লো পেনের দল আরএন দীর্ঘদিন ধরে ঘৃণা করে আসছে।
মৌরিতানিয়ান ও সেনেগালিজ পিতা-মাতার সন্তান ফাতিমা হিজাব পরেন। তার জন্ম প্যারিসেই। শহরটির উপকণ্ঠে যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস, সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। অন্য অনেকের মতো তিনিও দ্বৈত নাগরিক।
অতীতে লো পেন পাবলিক স্পেসে বা জনসম্মুখে হিজাব নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে জিতলে পেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন জর্দান বারদেলা। তিনিও মনে করেন, হিজাব হলো বৈষম্যের হাতিয়ার।
বারদেলা বেড়ে উঠেছেন প্যারিসের উত্তরের জনবহুল সেইন সঁ দেনিস এলাকায়। তিনি বরাবরই ফ্রান্স থেকে দ্বৈত নাগরিকদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
গত জুনে এক সভায় ২৮ বছর বয়সী বারদেলা বলেন, “আমার নিজের দেশেই বিদেশির মতো অনুভব করার তীব্র অনুভূতি আমি পেয়েছি। আমার পাড়ার ইসলামীকরণের প্রক্রিয়াও আমি দেখতে পেয়েছি।”
সেইন সঁ দেনিসের আরেক বাসিন্দা ফাতিমাতা।
তিনি বলেন, “১৩ বছর বয়সে আমি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করি। আজও আমার মনে হয়, বনলিয়েতে আমার মতোই আরেক ১৩ বছর বয়সী মেয়ে আছে, যে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না, কারণ ফ্রান্সের প্রধান রাজনৈতিক দল এখন ন্যাশনাল র্যালি।”
ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের ভোটে উগ্র-ডানপন্থীদের কাছে হেরে যাওয়ার পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আগাম নির্বাচনের ডাক দেন। কিন্তু তার এই চাল কাজে দেয়নি, উল্টো বুমেরাং হয়েছে।
গত রবিবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে ন্যাশনাল র্যালি ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর বামপন্থীদের জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট ২৮ দশমিক ১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোট পেয়েছে মাত্র ২০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট।
প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর উগ্র ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে।
বিপণনের সঙ্গে জড়িত ২৭ বছর বয়সী ফরাসি নাগরিক ইলিয়াস জানান, অনেক মুসলিম এরই মধ্যে ফ্রান্স ত্যাগ করার কথা ভাবছেন ন্যাশনাল র্যালির জয়ের খবরে।
তার মনে এই ভাবনা নেই। তিনি বলেন, “আমরা সবাই চলে গেলে কারা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখবে? আমি মনে করি ফ্রান্সে থেকে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।”
দেশ ছাড়ার কথা চিন্তা না করলেও উদ্বেগ রয়েছে ইলিয়াসের।
তিনি বলেন, “পুলিশি সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনা এখন আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে জাতিগত সহিংসতা বাড়তে পারে। কারণ ওই পুলিশ অফিসারদের সমর্থন ও সুরক্ষা দেবে ন্যাশনাল র্যালি।
“আমার ছোট ভাইকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। ওর বয়স এখন ১৫। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সে পুলিশের তল্লাশির শিকার হয়।”
এ বছরের শুরুতে ‘লা ফ্রান্স, তু লেম মে তু লা কিত’ শিরোনামের একটি গবেষণার লেখকরা এক হাজারের বেশি মানুষের উপর একটি সমীক্ষা চালান। এতে ১৪০ জনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার দাতারা ‘ইসলামোফোবিয়ার ক্ষতিকর প্রভাবের’ কারণে ফরাসি মুসলিমদের চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।
বারদেলার দ্বৈত নাগরিকদের নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভীত আলজেরিয়ান বংশোদ্ভুত তিজিরি মেসুদেন। তিনি থাকেন ফ্রান্সের দক্ষিণে। সেখানে ন্যাশনাল র্যালি ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
তিনি বলেন, “ন্যাশনাল র্যালি বলছে- দ্বৈত নাগরিকদের রাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানে কাজ করতে দেওয়া হবে না। আমি মনে করি, এটা এদেশে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপস করা হচ্ছে। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েছি এবং পাবলিক অ্যাফেয়ার্সে কাজ করতে চাই। যদি এই বিলটি পাস হয়, আমি কি তাহলে অকারণে পড়াশোনা করলাম?”
ন্যাশনাল র্যালির আগের নাম ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ১৯৭২ সালে দলটির প্রতিষ্ঠা করেন মারিন লো পেনের বাবা জ্য মারিন লো পেন। দলটি বর্ণবাদী বক্তব্যের জন্য পরিচিত।
ফ্রান্সের আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রিম সারাহ অ্যালোনে মনে করেন, ন্যাশনাল র্যালির পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে তাদের অনেক লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না।
কারণ হিসেবে তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “পাবলিক স্পেসে হিজাব নিষিদ্ধ করার বিল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করবে। অন্যদিকে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিল নাগরিকদের মধ্যে সমতার নীতি লঙ্ঘন করবে।
“ন্যাশনাল র্যালি একটি রাজনৈতিক দল যা অন্য কোনও দলের মতো নয়। এর মানে দলটি ক্ষমতায় এলে ব্যতিক্রমী কাজ করতে পারে।
“তাত্ত্বিকভাবে বিলগুলো সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু বাস্তবে, আমাদের দেখতে হবে দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলো কাউন্টারওয়েট হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করবে কি না?”
ম্যাক্রোঁর সরকারের অধীনে বিতর্কিত বিল যেমন আবায়া নিষেধাজ্ঞা, তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদ আইন এবং অভিবাসন সংক্রান্ত সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে নাড়া দিয়েছে।
অবশ্য তিজিরির মতে, মনে রাখা দরকার যে, ম্যাক্রোঁর আমলেও ফ্রান্সের মুসলিমরা ইসলামবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী পরিবেশের মধ্যে আছে।
সায়েন্সেস পো প্যারিসের একজন ডক্টরাল ছাত্র বেঞ্জামিন টেন্টুরিয়ার মিডিয়াতে উগ্র-ডানপন্থীদের বক্তৃতা নিয়ে গবেষণা করেন। তার মতে, ন্যাশনাল র্যালির উত্থানকে র্যাডিক্যাল বামপন্থীদের দানবীকরণের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে জ্যঁ-লুক মেলেশনের ফ্রান্স আনবোড পার্টির সঙ্গে।
তিনি বলেন, “১৫ বছর পর ন্যাশনাল র্যালি একটি উপনিবেশিক ও বর্ণবাদকে আরও সূক্ষ্ম রূপ দিয়ে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বর্ণবাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে সফল হয়েছে।
“ম্যাক্রোঁর রেনেসাঁ পার্টিও বামপন্থী বিরোধীদের কলঙ্কিত করেছে একই দানবীয় কৌশল ব্যবহার করে, যা আগে উগ্র-ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা