গোলাম সরওয়ারের চোখে ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। যশোরের রাইজিং স্টার ক্লাবের হয়ে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন এক সময়। যশোর প্রথম বিভাগ লিগে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে ঢাকায় খেলার সুযোগ মেলে।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলেন ইস্ট এন্ড ক্লাবে। কিন্তু সরওয়ারের নিয়তি যে লেখা অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে! তাইতো ক্রিকেটের ২২ গজ ছেড়ে নিয়মিত অ্যাথলেটিকসের ফিল্ডে দেখা মেলে শটপুট হাতে।
শনিবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শেষ হওয়া ৪৭তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে নৌ বাহিনীর হয়ে শটপুটে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন সরওয়ার। শুধু তাই নয় এবারের জাতীয় অ্যাথলেটিকসের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার উঠেছে তার হাতে।
সরওয়ার ছিলেন পেস বোলার। মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ পাওয়াটা কঠিন ছিল তার জন্য। যে ক্লাবে খেলেছেন সেখানে নিয়মিত একাদশে থাকার সুযোগও মিলছিল না। তাছাড়া পরিবার থেকে ক্রিকেট খেলাকে সমর্থন করতো না। এমন পরিস্থিতিতে ক্রিকেট খেলতে খেলতেই পেয়ে যান বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর চাকরি। মফস্বলে বেড়ে ওঠা সরওয়ারের পরিবার সরকারি চাকরিকেই প্রাধান্য দিতে বলেন তাকে। এজন্য ২০১২ সালে নৌ বাহিনীতে চাকরি হতেই প্রিয় ক্রিকেটকে জানিয়ে দেন বিদায়।
খেলাটা ছেড়ে মোটেও আক্ষেপে পুড়ছেন না। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের অ্যাথলেটিকসের পদকমঞ্চ থেকে নেমে তিনি বলছিলেন, “এটা নিয়ে আফসোস করিনা। কপালে যেটা আছে সেটা হবে। আসলে মফস্বলে বাড়ি হলে যা হয়। পরিবারের লোকজন সরকারি চাকরিটাকে বেছে নিতে বললেন। এজন্যই এটাকে বেছে নিয়েছিলাম। এতে কোনও আক্ষেপ নেই। ”
ভাগ্যক্রমে অ্যাথলেট হয়ে ওঠা সরওয়ারের। ঘটনাটা নিজেই বলছিলেন, “ সৈনিকদের মনোবল বাড়াতে আন্তঃঘাটিতে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। শটপুটে ৯ মিটারের ওপর স্কোর করি। এই পারফরম্যান্স দেখে নৌ বাহিনী ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডে আনা হয় আমাকে। সেখান থেকেই এই খেলাটার শুরু।”
মূলত প্রতিযোগিতার জন্য শটপুটে হাতেখড়ি ২০১৪ সালে। ১ বছর অনুশীলন করে প্রথমবার জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন ২০১৫ সালে। এরপর ২০১৯ সালে জাতীয় সামার মিটে জেতেন রুপার পদক। কিন্তু ওই বছরই জাতিসংঘ মিশনে দক্ষিণ সুদান যেতে হয় সরওয়ারকে। স্বাভাবিকভাবেই খেলাতে বিরতি পড়ে। মিশন শেষে দেশে ফেরেন ২০২০ সালে।
ফিরে ২০২২ সালে সামার মিটে অংশ নিয়েই জেতেন সোনা। সেবার স্কোর করেন ১৪.২৩ মিটার। ওই বছর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অবশ্য ১৩.৮৬ মিটার দূরত্বে গোলক ছুঁড়ে রুপা জেতেন। এরপর শনিবার করলেন ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স। ১৪.৮৯ মিটার ছুঁড়ে রেকর্ড গড়ে জিতলেন সোনা। এর আগে যে রেকর্ডটি ছিল এম ইব্রাহিমের। ২০১৯ সালে ১৪.৫৩ মিটার দূরত্বে গোলক নিক্ষেপ করে যে রেকর্ড গড়েন ইব্রাহিম। ৫ বছর পর সেটি এবার ভাঙলেন সরওয়ার।
অনুশীলনের সুযোগ সুবিধা ভালো নেই। তারপরও এমন পারফরম্যান্সে খুশি সরওয়ার, “ আমাদের দরকার অনুশীলনের সুবিধা। ভালোভাবে থ্রো করব, তেমন মাঠ নেই। পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থ্রো করি। ভালো সুযোগ সুবিধা পেলে আরও ভালো করতাম। যে টুকু সাফল্য পেয়েছি এতে আমার কোচ আনসার আহমেদ স্যারের অনেক অবদান রয়েছে।”
সাধারণত শটপুট থ্রোয়ারদের স্বাস্থ্যবান হতে হয়। কিন্তু সরওয়ারের ভারি স্বাস্থ্যে আপত্তি, “থ্রো ইভেন্ট যে খেলবে তাকে খেতে হবে। কিন্তু আমি বেশি খাবার খেয়ে মোটা হতে চাই না। এতে সমস্যা আছে। থ্রোয়ারদের অনেক খাবার এড়িয়ে চলতে নিয়মমাফিক খেতে হয়। আসলে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্র্যাকটিস করি।”
১০০ মিটারের মত আকর্ষণীয় ইভেন্টে বেশি নজর ফেডারেশনের। এটা নিয়ে দুঃখ করে বলছিলেন, “শটপুট, জ্যাভলিনের মতো ইভেন্টে নজর দেওয়া হয়না। অথচ এসএ গেমসের মতো প্রতিযোগিতায় যদি নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে উৎসাহ বাড়তো। আরও দায়িত্ব নিয়ে অনুশীলন করতে পারব। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করতে পারব।”
সরওয়ারের আরেকটি পরিচয় তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিশেষায়িত ফোর্স স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং অ্যান্ড সালভেজের (সোয়াডস) সদস্য। ২০১৩ সালে করেছেন সীল কমান্ডো কোর্স। যারা স্থল, জল ও আকাশে সমানভাবে নিরাপত্তায় পারদর্শী। সরওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু আপাতত শুধু খেলাতেই মনোযোগ, অনুশীলনে সময় বেশি ব্যয় করেন। এজন্য বিশেষায়িত ফোর্সের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে না।
জানালেন কবজির ব্যাথায় এবার সেরা পারফরম্যান্স করতে পারেননি, “ থ্রো করতে গিয়ে কবজিতে ব্যথা পেয়েছি। প্রথমবার যা করেছি সেটাই টপকাতে পারেনি কেউ। আমি ভালো সুযোগ সুবিধা পেলে ১৫ থেকে ১৬ মিটার থ্রো করতে পারব। এমন স্কোরে এসএ গেমসেও পদক আশা করতে পারি।”
জাতীয় অ্যাথলেটিকসে সেরা হওয়ার পর এখন সরওয়ারদের মতো অ্যাথলেটদের প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী উন্নত প্রশিক্ষণ। তাহলে হয়তো এদের হাত ধরেই বাংলাদেশ পেতে পারে অবহেলিত ইভেন্টগুলোতে আন্তর্জাতিক পদক।