আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। রাত পেরোলেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। অন্যবার এ সময়ে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা মিলত না গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে। সঙ্গে বাসের অপেক্ষা, সময় পেরিয়ে বাস আসার যন্ত্রণাতো ছিলই। বাসের অপেক্ষায় থাকা হাজার হাজার যাত্রীর অনেকে বাস না পেয়ে ঢাকা ছাড়তেন পিকআপ ভ্যান বা ট্রাকে।
কিন্তু এবার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের দৃশ্য যেন অচেনা। সেখানে নেই সেই চিরচেনা ঈদের চাপ। বাসস্ট্যান্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক বাস, কিন্তু যাত্রীর দেখা নেই। বিভিন্ন কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতাদেরও নেই ব্যস্ততা। কেউ সময় কাটাচ্ছেন মোবাইলে ভিডিও গেমস খেলে, আবার কেউ আড্ডা দিয়ে, কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ছেন কাউন্টারে বসেই।
এবার এমন পরিস্থিতি কেন? এমন প্রশ্নে পরিবহন শ্রমিকরা জানান, এবারের ঈদে ধাপে ধাপে ছুটি পেয়েছে সবাই। তাই অনেক আগে থেকেই ঢাকা ছাড়া শুরু করেছে যাত্রীরা। এ কারণে ঈদের আগের দিনে যাত্রী চাপ নেই বললেই চলে।
এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশি যাত্রীর চাপ ছিল গত সোমবার। ওইদিন ঢাকা ছেড়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ। অনেকে সেদিন টিকিট পায়নি। কিন্তু এর আগে পরে কোনও সমস্যা হয়নি। সোমবার ছাড়া সড়কে যানজট না থাকায় বাসগুলোও যাতায়াত করতে পেরেছে সময়মতো।
গাবতলী থেকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর রুটে চলাচল করে জননী পরিবহন। তাদের কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায় চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন টিকিট বিক্রেতা। ঘুম ভাঙলে টিকিটের কথা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, “সব জায়গার টিকিট আছে, কই যাবেন?” সাংবাদিক পরিচয় জেনে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, “ভাবছিলাম যাত্রী আইছে?”
নিজের নাম মাকানুর রহমান জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের আগে গাবতলীর এমন চেহারা আগে কখনও দেখিনি। এখনও আমাদের ৪টি গাড়ি স্ট্যান্ডে পড়ে আছে, কিন্তু কোনও যাত্রী নেই। যে গাড়িগুলো ছেড়েছে সেগুলোতেও সিট ফাঁকা ছিল।”
পাশেই গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মো. আসাদ মুঠোফোনে গেমস খেলছিলেন। হতাশ কণ্ঠে জানালেন, যাত্রী খুবই কম। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকজন যাত্রী আসছে। অথচ গত ঈদেও এ সময়ে দম ফেলার ফুরসৎ পাইনি। একটি টিকিটের জন্য মানুষ অনেক অনুরোধ করেছে। ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারিনি। বাসের ইঞ্জিন কাভারে বসে ৭-৮ জন যেতেন, এমনকি দাঁড়িয়ে হলেও যাবেন বলেছেন যাত্রীরা।
ঝিনাইদহগামী সুমন ডিলাক্স পরিবহনের টিকিট বিক্রেতাকেও দেখা গেল মোবাইলে গেমস খেলতে। নিজের নাম মো. মুরাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “এবার স্কুল-কলেজ অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে। তাই অনেকে পরিবারের সদস্যদের আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারপরও অন্যান্যবারের তুলনায় এবার বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ অনেক কম।”
শ্যামলী পরিবহনের গাবতলীর কাউন্টারম্যান সোহেল আহমেদ বলেন, “আমাদের এখানে সব গন্তব্যেরই টিকিট আছে। এবারের ঈদে লম্বা ছুটি। তাই এই অবস্থা। শুধু সোমবার যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। এর আগে পরে স্বাভাবিক দিনের মতো যাত্রী চলাচল করেছে।”
গাবতলীতে পরিবহন ব্যবসার বর্তমান অবস্থা খুব খারাপ দাবি করে তিনি বলেন, “গাবতলীতে এখন শুধুমাত্র উত্তরাঞ্চলের যাত্রী পাওয়া যায়। পদ্মা সেতু হওয়ার পর বরিশাল, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রী নেই বললেই চলে। ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এসব এলাকার মানুষ এখন সায়েদাবাদ থেকে বেশি চলাচল করে।”
অন্যান্যবার যানজটের কারণেও গাবতলীতে যাত্রীর চাপ বাড়তো বলে জানান হানিফ পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা কাউসার আহমেদ। তিনি বলেন, “যানজটে বাস সময়মতো না এলে যাত্রীরা বাসস্ট্যান্ডেই আটকে থাকত। এবার সড়কে তেমন যানজট নেই। বাসগুলো সময়মতো কাউন্টারে এসে যাত্রী নিয়ে আবার গন্তব্যে রওনা দিতে পারছে। তাই যাত্রীদের জটলা তৈরি হচ্ছে না।”
শেষমুহূর্তে বাড়ির পথে শ্রমজীবীরা
ঈদের আগের দিন বুধবার যারা ঢাকা ছাড়ছেন তাদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষ। গাবতলী বাসস্ট্যান্টে যাত্রীদের ভিড় দেখা না গেলেও কম ভাড়ার আশায় আমিন বাজার ব্রিজের গোড়ায় অনেককে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কল্যাণপুর-গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোর হেলপারের সঙ্গে দামাদামি করে কম ভাড়ায় বাসে উঠছে যাত্রীরা।
তাদেরই একজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর উপজেলার রবিউল ইসলাম। ঢাকার আজিমপুর এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন তিনি। বাড়িতে অপেক্ষায় আছে বাবা-মা-স্ত্রী আর দুই মেয়ে। রবিউল বলেন, “আমরা হাজিরার ওপর টাকা পাই। তাই যতদিন পারলাম কাজ করলাম। কাউন্টারে বাসের টিকিটের দাম বেশি, তাই এখানে দাঁড়াইছি। কাউন্টারে টিকিটের দাম সাড়ে ৮০০ টাকা, এখান থেকে উঠলে ৫০০ টাকার মধ্যে বাড়ি যেতে পারব।”
রিকশাচালক মজনু মিয়ার বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলায়। কম টাকায় গ্রামে যাওয়ার আশায় তিনিও আমিনবাজার ব্রিজে এসেছেন। ডিপজল পরিবহনের একটি বাসের হেলপারের সঙ্গে কথা বলে টিকিটের দাম কমানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। মজনু বলেন, “আমি প্রতিমাসে বাড়ি যাই। এখান থেকে গেলে কম টাকায় বাসে ওঠা যায়। তাই কাউন্টারে না গিয়ে এখানে এসেছি।”