ঈদের ছুটি শুরুর দুদিন আগে সোমবার বিকাল পর্যন্ত ৬০ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক বেতন-বোনাস পায়নি বলে শিল্প পুলিশ জানিয়েছিল। কিন্তু শেষ কর্মদিবসে এই হার তাদের হিসাবে ১৩ শতাংশে নেমে আসে।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রায় ৮৭ শতাংশ কারখানার শ্রমিকরা মার্চের বেতন এবং ঈদ বোনাস পেয়েছে বলে শিল্প পুলিশের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়।
বিজিএমইএ দাবি করেছে, মঙ্গলবারের মধ্যে শতভাগ কারখানায় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে।
তবে শ্রমিকদের ভাবনা অন্য জায়গায়। তারা বলছেন, শেষ সময়ে হাতে টাকা পাওয়ায় পরিবারের জন্য ব্যয় করার সুযোগ তাদের থাকে না। আবার বাড়ি ফেরার যানবাহন পাওয়াও মুশকিল হয়ে পড়ে।
ঈদুল ফিতরে তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হচ্ছে বুধবার। তিন দিনের ছুটির পর শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি এবং রোববার পহেলা বৈশাখের ছুটি মিলিয়ে এবার টানা পাঁচ দিন ছুটি থাকছে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলোর অধিকাংশই ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর সদর ও টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। দেশের প্রায় অর্ধ কোটি পোশাক শ্রমিকের অধিকাংশ এখানেই কাজ করেন।
প্রতি বছরই ঈদের আগে বেতন-বোনাসের জন্য পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন দেখা যায়। এমনকি ঈদের দিন অনশনে বসারও নজিরও আছে। কিন্তু এবার বেতন-ভাতা নিয়ে বড় কোনও আন্দোলন দেখা যায়নি।
এবার বেতন-বোনাস পরিশোধে সমস্যা হতে পারে, এমন ৪১৬টি কারখানা চিহ্নিত করে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারক ও শিল্প মালিকদের আগেই সতর্ক করেছিল শিল্প পুলিশ।
৮৭ % কারখানার বেতন পরিশোধ
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দেশের আট শিল্প ও শ্রমঘন এলাকায় মার্চের বেতন পেয়েছে ৮৬ দশমিক ৬১ শতাংশ কারখানার শ্রমিক।
আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেট এ আট শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় মোট কারখানা রয়েছে ৯ হাজার ৪৬৯টি।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৯ এপ্রিল দুপুর ১২টা পর্যন্ত এসব এলাকার ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ কারখানার শ্রমিক মার্চের বেতন পাননি। তবে ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে ৯৭ দশমিক ১০ শতাংশ কারখানা।
শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় শ্রমঘন কারখানাগুলো মূলত পোশাক ও বস্ত্র খাতের। আট শিল্প এলাকায় তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের বড় সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৫৬১।
শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে, এর মধ্যে ৮২ দশমিক ৫৮ শতাংশ কারখানার বেতন পরিশোধ হয়েছে। ৯ এপ্রিল দুপুর ১২টা পর্যন্ত বকেয়া ছিল ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ কারখানার বেতন। বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে ৯৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কারখানায়।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানা রয়েছে ৬২৬টি।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে বোনাস দিয়েছে শতভাগ কারখানা। বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৭৩ দশমিক ১৬ শতাংশ কারখানায়। ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ কারখানার শ্রমিক বেতন পায়নি।
বস্ত্র শিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সদস্য কারখানা ৩৪৭টি। এর মধ্যে ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ কারখানায় বেতন পরিশোধ হয়েছে বলে শিল্প পুলিশ জানিয়েছে। ৯ এপ্রিল দুপুর ১২টা পর্যন্ত বকেয়া ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ কারখানার বেতন। বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে ৯৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ কারখানায়।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজার) আওতাধীর মোট কারখানা ৪২৩।
শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, এর মধ্যে ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে। বোনাস দেওয়া হয়েছে ৯৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ কারখানায়।
কোনও সংগঠনের আওতায় নেই এমন কারখানার সংখ্যা ৬ হাজার ৪২০।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ তাদের বেতন পরিশোধ করেছে। বোনাস দেওয়া হয়েছে ৯৭ দশমিক ১০ শতাংশ কারখানায়।
‘মেশিন বিক্রি করে’ বেতন-বোনাস পরিশোধ
বিজিএমইএ নেতাদের দাবি, এবার ঈদ সামনে রেখে বেতন পরিশোধে মালিকদের অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেননা পোশাক কারখানার ক্রয়াদেশ কিছুটা বাড়তে শুরু করলেও দাম অনেক কমিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা।
সোমবার মিরপুরে এক কারখানা মালিক মেশিন বিক্রি করে রাতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করেন বলে দাবি করেছেন বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেখানেই সমস্যার হচ্ছে সেখানেই দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যে কারখানাগুলোর সমস্যা আমাদের নজরে এসেছে, সেগুলোর সমাধান করেছি। নতুন করে দুটি কারখানায় (একটা আশুলিয়া ও একটা মিরপুরে) সমস্যা জানা গেছে।
“এর আগে মিরপুরের একটি কারখানার মেশিন বিক্রি করে সমস্যা সমাধান করা হয়েছে।
দুই-চার-পাঁচটা কারখানায় সমস্যা বাদে আর সমস্যা থাকবে না।”
তিনি বলেন, “আমাদের সদস্য কারখানাগুলোর অধিকাংশেরই বোনাস পরিশোধ হয়ে গেছে। দুই-চার-পাঁচটা কারখানা সবসময়ই শ্রমিকের সঙ্গে সমঝোতা করে। কিন্তু মোটামুটিভাবে দেওয়া হয়ে গেছে। বেতনও এখন পর্যন্ত মোটামুটি ৮৮-৮৯ শতাংশ কারখানার পরিশোধ হয়ে গেছে।”
পোশাক শিল্পোদ্যোক্তারা সমস্যায় রয়েছে দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “ব্যবসার ক্রয়াদেশ বাড়ছে। কিন্তু অবস্থা ভালো না। ফলে মালিকদের বিভিন্নভাবে অর্থ জোগাড় করেছে। কেউ ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, প্রোপার্টি বিক্রি করেছে কেউ কেউ। ফলে বেতন-বোনাস দিতে দিতে শেষ দিনে গড়িয়েছে।”
রাতে বিজিএমইএর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তাদের সংগঠনভুক্ত শতভাগ কারখানায় শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে।
বাড়ি ফেরায় অনিশ্চয়তা
কয়েকজন শ্রমিক নেতা বলছেন, বেতন-বোনাস নিয়ে বরাবরই অনিশ্চয়তায় থাকে শ্রমিকরা। ছুটির আগের দিন বেতন-বোনাস দেওয়ার ফলে শ্রমিকরা পরিবারের জন্য অর্থ খরচ করার সুযোগ পায় না।
জামালউদ্দিন সুয়িং অপারেটার হিসেবে কাজ করেন গাজীপুরের এক কারখানায়। তিনি সকালে বেতন-বোনাস পেয়েছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছুক্ষণ আগে পেলাম। এতদিন জানতামও না, পাব কি না? এখন এমন এক সময় পেলাম, বাড়ির জন্য বাজার করার সময়টুকু নেই। এখনই রওনা দেব বাড়ির দিকে। রাস্তায় জ্যাম শুনতাছি। কখন পৌঁছাব, তাও জানি না।”
বেতন-বোনাস নিয়ে এই অনিশ্চয়তা শ্রমিকদের ঈদ আনন্দ মাটি করে দেয় মন্তব্য করে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামীম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগে সরকার ঠিক করে দিত, কবের মধ্যে বেতন-বোনাস দিতে হবে। কিন্তু মালিকের চাপে এখন আর সেটা ঠিক করে দেয় না সরকার। ফলে মালিকরা শেষ দিনে নিয়ে যায় শ্রমিকের বেতন-বোনাস। আগে থেকে জানাও যায় না, বেতন হবে কি না?”
তিনি বলেন, “শ্রমিকদের ঈদ পালনের অধিকার রয়েছে। মালিকরা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেতন-বোনাস দিত, তাহলে একজন শ্রমিক ঈদ নিয়ে একটি পরিকল্পনা করতে পারত। কিন্তু শেষ দিন বেশিরভাগ কারখানা বেতন-বোনাস দেওয়ায় এই সুযোগ শ্রমিক পায় না।”
ছুটি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করে এই শ্রমিক নেতা বলেন, “শ্রমিকরা ঈদের ছুটিটাও ঠিক মতো পায় না। ঈদের ছুটি ছয়-সাতদিন হবে- এবার এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে থেকেই শ্রমিকদের ওভারটাইম করানো হয়েছে। যাদের বাকি আছে তারা ঈদের পরে ওভারটাইম করিয়ে নেবে। প্রাপ্য ছুটিটার জন্যও শ্রমিকের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।”