ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও প্রত্যাশিত মাত্রায় বেতন-ভাতা সমন্বয় না হওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের অসন্তোষ বাড়ছে। ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে ।
গত সপ্তাহে নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী মজুরি দেওয়া শুরু হলেই শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
শ্রমিকদের অভিযোগ, একই গ্রেডে কয়েক বছর কাজ করার পর জুনিয়র ও সিনিয়রের বেতন প্রায় একই রয়ে গেছে। মালিকরা পদোন্নতি আটকে রেখে তাদের গ্রেড কমিয়ে রেখেছে।
পোশাক শিল্প মালিকরা বলছেন, তারা বিষয়টি নজরে রেখেছেন এবং তা সমাধানে সচেষ্ট।
শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে গত বছরের শেষ দিকে পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তাতে গ্রেডের সংখ্যা সাত থেকে পাঁচে কমিয়ে আনা হয়।
শ্রমিক সংগঠনগুলো ন্যূনতম মজুরি ২৩-২৫ হাজার টাকা দাবি করে আসছিল। এখন গ্রেড নিয়েও দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
শ্রমিকদের অসন্তোষ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুরের এক শ্রমিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ৬ বছর ধরে কাজ করছি, কিন্তু এখনও আমাকে দুই নম্বর গ্রেডে রাখছে। আবার যে ২ বছর ধরে কাজ করে, তাকেও দুই নম্বর গ্রেডে রাখছে।”
টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর সুমি অ্যাপারেলসের আরেক শ্রমিক বলেন, “আমরা ৬ তারিখ কর্মবিরতিতে যাই। আমরা ফ্লোরে শান্তভাবে বসে ছিলাম। লাঞ্চের পরে আমাদের ছুটি ঘোষণা করা হয়৷ সন্ধ্যায় নোটিস দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।”
শ্রমিক অসন্তোষের জেরে টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীতে সুমি অ্যাপারেলস, দিশারী ইন্ড্রাস্ট্রিজ এবং গোল্ডস্টার ফ্যাশন নামের তিন কারখানার ৩৫ জন শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়।
কারখানাগুলো গত ৮ জানুয়ারি থেকে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী বন্ধ ছিল। ৯ তারিখ বিজিএমইএ কার্যালয়ে মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ এবং সরকারের বৈঠক হয়। তাতে কারখানা তিনটি খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু সেই ৩৫ শ্রমিকের চাকরি ফেরত আসেনি। ৩৫ শ্রমিককে তার বকেয়া পাওনাসহ সব সুবিধা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠক থেকে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শ্রমিকদের দাবি ও বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অনুসারে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি। তারপর যতটুকু মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে, তা থেকেও নানান অপকৌশলে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, আগের গ্রেড সমন্বয় করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি বলে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা তাকে জানিয়েছেন। আর এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বরখাস্ত করা হচ্ছে শ্রমিকদের।
গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক নিবর্তন বন্ধের পাশাপাশি কর্ম পরিবেশ অবনতি না হতে দিতে শিল্প সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
মালিকদের ভাষ্য
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান চলমান অসন্তোষ নিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছু কারখানায় সমস্যা হয়েছিল। আমরা সেটাতে নজর দিয়ে বেশিরভাগ কারখানার সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছি। কিছু বাকি আছে, তাও সমাধান করে ফেলব।”
শ্রমিকদের গ্রেডিংসহ নানা অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেন, “কারখানার প্রত্যেকের গ্রেডিং দেখে রাখা বিজিএমইএর পক্ষে তো কঠিন।
“পূর্বে যে শ্রমিক যে গ্রেডে মজুরি পেত, আমরা নিশ্চিত করতে চাই, যেন নতুন মজুরি কাঠামোতে তাকে নিচের গ্রেডে নামানো না হয় এবং সরকার নির্ধারিত মজুরি যেন সকল গ্রেডের সকল শ্রমিক ঠিকঠাক মতো পায়।”
শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোয় কারখানা মালিকরা চাপে পড়েছে দাবি করে ফারুক বলেন, “যে মজুরি কাঠামো হয়েছে, তা দিতে গেলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাও সরকার নির্ধারিত মজুরিই দিতে হবে, আমরা এ বিষয়টি তদারকি করছি।
“কিন্তু শ্রমিক ভাইবোনদেরও বুঝতে হবে, গ্যাসের দাম বেড়েছে, ডলার সঙ্কট, সব কিছু মিলে ব্যবসা পরিচালনা খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এখন যদি তারা আরও বেশি মজুরি ডিম্যান্ড করে, তাহলে কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।”
শ্রমিকদের পাওনা নিশ্চিতে সরকার কী করছে- জানতে চাইলে শ্রম দপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক আবু আশরীফ মাহমুদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়ে সরাসরি কোনও বিধিমালা নেই। এটা কারখানাগুলোই ঠিক করে, কে কোন পদবির হবেন। তবে আমরা যখন মজুরি ঠিক করি, তখন পদবিসহ গ্রেড উল্লেখ করি, যেন সবাই বোঝে, কোন পদবি কোন গ্রেডে অর্ন্তভুক্ত।”
পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমাদের অনেক ধরনের কারখানা নিয়ে কাজ করতে হয়। ফলে আমাদের পক্ষে শুধু পোশাক কারখানার শ্রমিকদের পারফরম্যান্স বিচার করা কঠিন।”
“তবে আমাদের বিভাগ আছে যারা কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলো প্রতিনিয়ত দেখা শোনা করে। কারও অভিযোগ থাকলে তাদের জানালে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি।”