Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

লাল সাগরের সংঘাতের ঢেউ পোশাক শিল্পে

রপ্তানি আদেশের কাজ গোছাতে কর্মব্যস্ত পোশাক শ্রমিকরা।
রপ্তানি আদেশের কাজ গোছাতে কর্মব্যস্ত পোশাক শ্রমিকরা।
[publishpress_authors_box]

লোহিত সাগরের সংঘাতের ঢেউ এসে পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে বাড়তি জাহাজ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করতে না পারার এবং কন্টেইনার ঘাটতির সমস্যাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

জাপানের সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে এ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক মাস আগে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ এবং কয়েকটি কারখানা বন্ধের কারণে বাংলাদেশের এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬৫ শতাংশেরও বেশি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে দ্রুত সময়ে যায় লোহিত সাগর-সুয়েজ খাল হয়ে। কিন্তু গত নভেম্বরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হামলা শুরু করে।

এর প্রায় দুই মাস পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রতিশোধ নিতে ইয়েমেনে হুতিদের ওপর হামলা শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং কোম্পানিগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলতা চলছে।

বাংলাদেশকে এই সমস্যা দুটি কারণে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রথমত, পোশাক শিল্প এ দেশের অর্থনীতির প্রাণ। গত বছর প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে এই শিল্প থেকে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রধান বন্দরটি অগভীর, ফলে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াই অর্ডার সরবরাহে বাংলাদেশের বেশি সময় লাগে।

নিক্কেই এশিয়া বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম শিপিং কোম্পানির এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, শিপিং কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় কন্টেইনার পরিবহনের খরচ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধি এখানেই থেমে থাকবে না। আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

গত জানুয়ারিতে ৫৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির পরও কম মুনাফা নিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টগুলো চলছিল। কিন্তু পরিবহন খরচের ঊর্ধ্বগতি দেশটির গার্মেন্ট মালিকদের জন্য আরেকটি মারাত্মক ধাক্কা হয়ে এসেছে। এই কারণে কিছু কারখানা ব্যবসা হারাচ্ছে।

শোভন ইসলামের স্প্যারো গ্রুপ বানানা রিপাবলিক, জে. ক্রু এবং মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের মতো শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে। গত সপ্তাহে তিনি জানান, শীর্ষস্থানীয় এক আমেরিকান ক্রেতার কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১ লাখ ৫০ হাজার পিস পোশাকের অর্ডার হারিয়েছেন তিনি।

স্প্যারো গ্রুপের মালিক শোভন ইসলাম বলেন, “সময়মতো পণ্য সরবরাহের জন্য কোনও জাহাজ খুঁজে পেলাম না। প্রায় সব বড় শিপিং কোম্পানিই আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে কেপ অফ গুড হোপ পার হচ্ছে। এতে শিপিংয়ের সময় কমপক্ষে ১০ দিন এবং খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ছে।”

আমেরিকার ক্রেতার ওই অর্ডার শেষ পর্যন্ত পেয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার এক প্রতিযোগী। তারা আরও কম সময়ের মধ্যে অর্ডার সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল বলেও শোভন জানান।

“পশ্চিমা ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষির টেবিলে আমরা সবসময় পিছিয়ে থাকি আমাদের শিল্পের লিড টাইম ঘাটতির কারণে”, বলেন তিনি।

পণ্য অর্ডার ও সরবরাহ করা পর্যন্ত সময়কে লিড টাইম বলে।

বিশ্বে চীনের পর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। কিন্তু দেশটির এই শিল্পের লিড টাইম অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। কারণ বাংলাদেশের মূল বন্দর চট্টগ্রামের অগভীরতা। এতে বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পণ্য দীর্ঘতর রুট দিয়ে পরিবহন করতে হয়।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট রপ্তানিকারকরা সাধারণত চট্টগ্রাম থেকে ছোট কার্গো জাহাজে করে পণ্য রপ্তানি করে। ওই জাহাজগুলো কলম্বো, সিঙ্গাপুর, কেলাং বা তাঞ্জুং পেলাপাস বন্দরে থাকা বড় জাহাজে পণ্য পৌঁছে দেয়। এই প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশের লিড টাইম প্রায় ১৫ দিন।

লিড টাইমের এই সমস্যা বাংলাদেশকে চীন ও মিশর থেকে সুতা আমদানির ক্ষেত্রেও পোহাতে হয়। সুতা প্রথমে ছোট কার্গো জাহাজে চট্টগ্রামে আনা হয়। এরপর যায় কারখানায়। এর মাঝে চলে যায় ১০ দিন।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শোভন ইসলাম বলেন, “অন্য গার্মেন্ট উৎপাদনকারী দেশের চেয়ে আমরা ১৫-২০ দিন বেশি সময় নেই। ফলে ক্রেতারা আমাদের অনেক সস্তা মূল্য দেয়। লিড টাইমের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় ঝুঁকিতে থাকি। পণ্য সরবরাহে সামান্য ব্যাঘাত আমাদের মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। লোহিত সাগরের এই সংঘাত সম্ভবত ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের চেয়েও বাংলাদেশকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

শোভনের স্প্যারো গ্রুপের মতো অনেক পোশাক কারখানা এখন অর্ডার হারাচ্ছে বা ক্ষতির মুখে পড়ছে।

আরডিএম গ্রুপের মালিক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলছেন, তাকে তার ইউরোপীয় ক্রেতা নতুন বছরের শুরুতে বিমানের মাধ্যমে পণ্য পাঠাতে বলেছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন রাকিবুল আলম চৌধুরী।

তিনি বলেন, “বিমানের মাধ্যমে পণ্য পাঠানোর খরচ সাধারণ শিপমেন্টের চেয়ে ১০-১২ গুণ বেশি। বিমানে শিপমেন্ট করলে সেই অর্ডারের জন্য আমরা লোকসানে পড়ব। কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্প নেই। কারণ সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে আমরা সেই ক্রেতার কাছ থেকে আর অর্ডার পাব না।”

কিছু পোশাক রপ্তানিকারক চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার খুঁজে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ৭৫ শতাংশের বেশি রপ্তানিকারক তাদের পণ্য শিপিংয়ে ৪০ ফুটের কন্টেইনার ব্যবহার করেন। কিন্তু এখন এই ধরনের কন্টেইনারের তীব্র ঘাটতি রয়েছে।

বিআইসিডিএর সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন সিকদার বলেন, “সুয়েজ খালের পরিবর্তে কেপ অফ গুড হোপ রুটে জাহাজ চলায় কন্টেইনারগুলো কমপক্ষে ২৫ দিন বেশি সময় সমুদ্রে থাকে। ফলে কন্টেইনার সংকট তৈরি হয়।”

তিনি আরও বলেন, “রপ্তানিকারকরা ২০ ফুটের ছোট কন্টেইনারে পণ্য পাঠাতে পারেন। কিন্তু এতে শিপিং খরচ আরও ৩০ শতাংশ বাড়ে। ফলে তারা এই পন্থা বেছে নিতে অনিচ্ছুক।”

লোহিত সাগরের ঝামেলা ছাড়াও গার্মেন্ট রপ্তানিকারকদের ওপর অন্য চাপও আছে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্ট রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে ৬ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “গত বছর বাংলাদেশ কমপক্ষে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আশা করেছিল। কিন্তু প্রথমার্ধের পর অর্ডার ও প্রবৃদ্ধি থেমে যাওয়ায় সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। সুতার দাম বাড়ায় আমাদের উৎপাদন খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, আয় তেমন বাড়েনি।”

বিজিএমইএর বর্তমান সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই কিছু বড় সংকট কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু লোহিত সাগরের এই সমস্যা আমাদের জন্য বড় বিপত্তি ডেকে আনবে। লিড টাইম বাড়ায় অনেক চাপ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত