ঢাকার অনেক এলাকায় ইদানিং সকালের নাস্তা সকালে বানানোর সুযোগ নেই। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে রান্নাঘরে ঢুকতে পারলেই কেবল কম সময়ে সকালের নাস্তা বানানো সম্ভব। কারণ ভোর থেকে সময় যত গড়ায় চুলায় গ্যাসের চাপ ততই কমতে থাকে। কমতে কমতে দুপুরের রান্নার সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা বলা বাহুল্য মাত্র।
গ্যাসের এই তীব্র সংকট শিগগির যে কাটবে না, তা ইতিমধ্যে বলেও দিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
সংশ্লিষ্টদের কথা অনুযায়ী, মূলত দুই কারণে এই সংকট। প্রথম কারণ শীত মৌসুম। দ্বিতীয় কারণ কম গ্যাস উৎপাদন।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ১৫০ কোটি ঘনফুট। এই ঘাটতি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সংকট থেকে যাবে।
এই ঘাটতির কারণেই ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় জ্বলছে না চুলা, শিল্প কারখানাগুলোও পাচ্ছে না প্রয়োজনমতো গ্যাস। শিগগির এই সংকট নিরসনের সম্ভাবনাও দেখছেন না পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা।
দুই কারণ
গ্যাসের উৎপাদন যে কম হচ্ছে তা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু এই সংকটে শীত মৌসুম ভূমিকা রাখছে কী করে?
এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খানের কাছে।
শনিবার (২০ জানুয়ারি) তিনি সকাল সন্ধ্যাকে জানান, শীত মৌসুমে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় অনেক স্থানে গ্যাস লাইনে ফেনা জমে যায়। এতে লাইনে গ্যাসের চাপ বাধাগ্রস্ত হয়। ফল টিমটিমে গ্যাসের আগুন।
দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট- একথা জানিয়ে কামরুজ্জামান বলেন, “মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে বড় ধরনের অসুবিধা হয় না।”
কিন্তু সেই ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ ধরে রাখা যায়নি উল্লেখ করে পেট্রোবাংলার এ কর্মকর্তা বলেন, “গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে কম। তাই এখন দিনে সরবরাহ ২৫০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে।”
পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ করা হয়েছে ২৫২ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
আগের দিন বুধবার এই অঙ্ক ছিল ২৫৬ ঘনফুট। এক মাস আগে গত ১৭ ডিসেম্বর সরবরাহ ছিল আরও কম, ২৩২ কোটি ঘনফুট। দুই মাস আগে গত ১৭ নভেম্বর ছিল ২৮০ কোটি ঘনফুট।
কামরুজ্জামান খান বলেন, “প্রতিদিন চাহিদা বাড়ছে। নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বাসাবাড়িতেও চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সরবরাহ বাড়ছে না, উল্টো কমছে।”
দেশের গ্যাস সংকট নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও কোনও উত্তর দেননি।
তবে শুক্রবার বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “জ্বালানি সংকট সমাধানের জন্য সরকার বহুমুখী জ্বালানি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জোর তৎপরতা আছে। এ বছরই সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া পরিবেশ ও কৃষিজমি রক্ষা করে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের জন্যও পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।”
১৪ জানুয়ারি নতুন করে দায়িত্ব নেওয়ার পর নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “মার্চের আগে গ্যাস সংকটের সমাধান হবে না।”
আওয়ামী লীগ সরকরারে গত মেয়াদেও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন হামিদ।
ধুঁকছে শিল্প-কারখানা
শীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, তাই এ খাতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ—দুইই কমেছে। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমায় অন্যান্য খাতে গ্যাস সরবরাহে ভাটা কাটেনি।
দেশেও গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এতে করে শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাস-সংকটে ভুগছেন। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকরা।
বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দৈনিক ১১০ থেকে ১১২ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে এ খাতে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ কোটি ঘনফুট। তবে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। সংকটের সময় সাধারণত অধিকাংশ সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়।
বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এখন সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে দিনে গড়ে ২২ কোটি ঘনফুট।
আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ছিল। এই টার্মিনালটিকে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হযয়েছিল। সেটি গত ১৭ জানুয়ারি মহেশখালীতে ফেরে। এরপর সংযোগ করতে গিয়ে কারিগরি ত্রুটিতে ঘটে বিপর্যয়।
একইসঙ্গে আরেকটি টার্মিনাল দেশীয় ‘সামিট এনার্জি’কে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। ফলে আগে থেকেই সেটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল। ফলে এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সামিট এনার্জি টার্মিনাল দিয়ে বিপর্যয় সামাল দেওয়া যায়নি।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শাহ আলম শনিবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এক্সিলারেট টার্মিনাল চালু হয়েছে। একইসঙ্গে সামিটের টার্মিনালে থাকা কিছু এলএনজি পাইপলাইনে সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে সকালে আমরা ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছি। দুপুর থেকে বিকাল নাগাদ সেই সরবরাহ আরও বাড়বে।”
গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসা-বাড়িতে গ্যাস নিয়ে সংকট কেটেছে বলে জানান শাহ আলম।
নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সংখ্যা আট শতাধিক। ডাইং প্রতিষ্ঠান তিন শতাধিক। সবখানেই গ্যাসের তীব্র সংকট আছে। গ্যাস-সংকটে কারখানার উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় (বিসিক) অবস্থিত এম বি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন মোহাম্মদ হাতেম। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখতে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। সরকার কি শিল্পকে গ্যাস দেবে না কি সার কারখানাকে গ্যাস দেবে, তা নির্ধারণ করতে হবে।
‘‘কিছু কিছু সার দেশে উৎপাদন করার চেয়ে আমদানি করলে কম ব্যয় হয়। সেসব সার উৎপাদন বন্ধ রেখে শিল্পে গ্যাস দেওয়া প্রয়োজন। গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ হবে। শ্রমিকরা কাজ হারাবেন।”
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন সকাল সন্ধাকে বলেন, “দুই সপ্তাহ ধরে গ্যাস-সংকট চরম অবস্থায় চলে গেছে।
‘‘নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার; গাজীপুরের শ্রীপুর ও সাভার এলাকায় সংকট বেশি। এসব এলাকার ডাইং কারখানাগুলো বেশি ভুগছে।”
তিনি বলেন, “গ্যাস সমস্যা নিয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা তিতাসের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনও কথা বলে না। এখন কাউকে ফোন দিলেও পাওয়া যায় না। বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত।”
জ্বলে না চুলা
রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকরা পোহাচ্ছেন চরম ভোগান্তি। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।
ঢাকায় রান্নার জন্য গ্যাস পাচ্ছেন না অনেক গ্রাহক। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কলাবাগান, বসুন্ধরা, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তিতাসের অভিযোগকেন্দ্রে গ্রাহকের ফোন আসছে গ্যাস না পেয়ে।
মিরপুরের বাসিন্দা তাছলিমা বেগম বলেন, “মধ্যরাতে গ্যাস আসে, এরপর সকাল ৮টার মধ্যেই চলে যায়। সারাদিন আর আসে না।”
শীত শুরু থেকে দিনের বেলায় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। মিট মিট করে জ্বলা চুলায় রান্না হয় না।
তবে সপ্তাহ খানেক ধরে পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানালেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা স্বম্পা ইসলাম। তিনি বলেন, “এখন এক সপ্তাহ ধরে সকাল ৭টায় গ্যাস সম্পূর্ণ চলে যাচ্ছে, আসছে ঠিক রাতের ১১টার দিকে।
‘‘ফলে দিনের বেলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। রাত জেগে যা রান্না করি সেগুলো দিনের বেলায় ওভেনে গরম করে খেতে হয়। গ্যাসের স্বল্পতার কারণে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।”
সাভারে গ্যাস সংকট তীব্র
শীতের শুরু থেকে ঢাকার সাভার উপজেলার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দিন থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী।
সাভার পৌর এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় গ্যাস-সংকট তীব্র হওয়ায় নিরুপায় হয়ে অনেকেই এলপিজি, বৈদ্যুতিক চুলা ও মাটির তৈরি চুলা দিয়ে রান্নার কাজ সারছেন।
গৃহিণী রোকসানা আক্তার বলেন, ‘‘আমরা ফ্ল্যাট বাসায় থাকি। শীত শুরু হতেই গ্যাস থাকছে না। ফলে চুলাও জ্বলছে না।’’
আশুলিয়ার বাসিন্দা হযরত আলী বলেন, গ্যাস না থাকায় চুলা জ্বলছে না। তাই রান্নাও হয় না, না খেয়েই কর্মস্থলে যেতে হয়।
পোশাক শ্রমিক সাহিদা বেগমসহ অনেকেই জানান, সকাল হলেই চুলা জ্বলে না। বিকল্প ব্যবস্থায় ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে কোনও রকমে লাকড়ি এনে রান্না করতে হচ্ছে।
আশুলিয়ার একটি ফ্যাশন কারখানার ব্যাবস্থাপক রফিকুল হক। তিনি জানান, তাদের কারখানায় গ্যাসের সংকট চলছে। মাঝে মধ্যে দিনে দুই-তিন ঘণ্টা গ্যাস পাচ্ছেন। তবে যখন আসছে তখন গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকছে। ফলে কারখানা বন্ধই রাখতে হচ্ছে। অনেক শিল্প মালিক গ্যাসের অভাবে সিএনজি দিয়ে কারখানা চালু রেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবু সালেহ মো. খাদেম উদ্দিন বলেন, ‘‘শীতে গ্যাসের প্রেসার এমনিতেই কম থাকে। দ্রুতই সমাধান করে এ সংকট নিরসন করা হবে।’’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আঞ্চলিক প্রতিবেদক]