Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গাজায় চেতনানাশক ছাড়াই অস্ত্রোপচার

রাফার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় আহতকে নিয়ে আসা হয়েছে। ছবি: বিবিসি।
রাফার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় আহতকে নিয়ে আসা হয়েছে। ছবি: বিবিসি।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

গাজার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কান্না থামছে না। দিনরাত সবসময়ই তাদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। সরবরাহ না থাকায় চিকিৎসকরা ব্যথা ও চেতনানাশক ছাড়াই ইসরায়েলি হামলায় আহতদের অস্ত্রোপচার ও পচনশীল ক্ষতের চিকিৎসা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাবে যাদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা দরকার তাদেরও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গাজার একজন চিকিৎসক বিবিসিকে বলেন, “ব্যথানাশক ওষুধ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীদের চিৎকার শুনতে হচ্ছে আমাদের।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, গাজার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা ‘ভাষায় প্রকাশ করার মতো না’। ২৩টি হাসপাতালে কোনও চিকিৎসাই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ১২টিতে আংশিকভাবে এবং একটিতে কোনোমতে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে।

ইসরায়েলের হামলার কারণে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে না পারায় হাসপাতালগুলোর এমন দুর্দশা বলে অভিযোগ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। তবে ইসরায়েল বলছে, হামাস পরিকল্পিতভাবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে ব্যবহার করছে।

এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, তারা হাসপাতালগুলোতে হামলা করেনি। হামাসের অবকাঠামো ও সরঞ্জাম রয়েছে শুধু এমন এলাকায় প্রবেশ করেছে। হামাসের অবকাঠামো ও সরঞ্জাম ধ্বংস করতে এবং হামাস সন্ত্রাসীদের ধরতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, তারা গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জামসহ মানবিক ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে কোনও বাধা দিচ্ছে না।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়াসহ কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।

রোগীদের উপচেপড়া ভিড়

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা বলছেন, গাজার বেশিরভাগ হাসপাতালেই রোগী উপচে পড়ছে। ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাবে সবাইকে প্রয়োজনমতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ গাজার হাসপাতালগুলোতে তিনশ শতাংশ বেশি রোগীর চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতকাল রবিবার জানায়, গাজায় ৩০৫ শয্যার চারটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে সর্বশেষ দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালেও চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে। কাছাকাছি হাসপাতালের কর্মীরা বলছেন, নাসের হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া তাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

আইডিএফ রবিবার রাতে বলেছে, তারা হাসপাতালটিতে অস্ত্রের পাশাপাশি জিম্মিদের নাম ও ছবিসহ ওষুধ পেয়েছে। সেখানে লুকিয়ে থাকা শতশত হামাস সদস্যকে আটক করেছে।

এর আগে আইডিএফ বিবিসিকে বলেছিল, হামাস তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য হাসপাতালগুলোকে ব্যবহার করে গাজার অসহায় নাগরিকদের বিপদে ফেলছে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসের গাজা ইউরোপিয়ান হাসপাতালের পরিচালক ইউসুফ আল-আক্কাদ সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে খারাপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শয্যা নেই। তাই কর্মীরা ধাতব ফ্রেম ও কাঠের ওপর বিছানার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে। অনেক রোগীকে খালি মেঝেতেও রাখা হচ্ছে।

গাজার অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকরাও একই পরিস্থিতির কথা বলছেন। রাফাহ শহীদ মোহাম্মদ ইউসুফ আল-নাজ্জার হাসপাতালের পরিচালক ডা. মারওয়ান আল-হামস বলেন, “‘হৃদরোগে আক্রান্তদেরও আমরা মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছি।”

ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম শেষ

চিকিৎসকরা বলছেন, সীমিত চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে কাজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসক আল-আক্কাদ বিবিসিকে বলেন, “আমরা এক ফোঁটা অক্সিজেনও খুঁজে পাচ্ছি না।

“আমাদের চেতনানাশক, আইসিইউর সরঞ্জাম, অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। ইসরায়েলি হামলায় আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদেরও ঠিকমতো ব্যথানাশক দিতে পারছি না।”

একজন চিকিৎসক চেতনানাশক ছাড়াই বেশ কিছু অস্ত্রোপচার হওয়ার কথাও নিশ্চিত করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দল জানিয়েছে, সম্প্রতি তারা গাজার ইউরোপীয়ান হাসপাতালে ৭ বছর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছে, যার দেহের ৭৫ শতাংশ বা চার ভাগের তিনভাগই পুড়ে গেছে। কিন্তু ব্যথানাশক শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে এখন সারাক্ষণ শুধু যন্ত্রণায় কাঁতরাতে হচ্ছে।

উত্তর গাজার আল-আওদা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সালহা বলেছেন, গাধা ও ঘোড়ার পিঠে করে রোগীদেরকে চিকিৎসার জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ব্যান্ডেজের অভাবে দুই বা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খোলা থাকার কারণে রোগীদের ক্ষতগুলোতে পচন ধরেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় চিকিৎসকরা হেডটর্চের আলোয় অপারেশন করছেন।”

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিবার বিচ্ছিন্ন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজায় প্রায় ২০ হাজার স্বাস্থ্যসেবা কর্মী রয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগই কাজ করতে পারছেন না। কারণ তারা নিজেদের পরিবার নিয়েই বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন।

ডা. আল-আক্কাদ বলেন, অন্যান্য এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুতরা এগিয়ে আসায় তার হাসপাতালে স্টাফ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে রোগীর সংখ্যা এবং ইসরায়েলি হামলায় তারা যেভাবে আহত হচ্ছেন- তা সামলানোর জন্য তারা যথেষ্ট নন।

তিনি বলেন, ইসরায়েলি বোমা হামলার পর যাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাদের বেশিরভাগেরই খুব খারাপ অবস্থা থাকে। বেশিরভাগ রোগীরই শরীর থাকে দুমড়ানো-মুচড়ানো বা আগুনে ঝলসে যাওয়া।

“প্রায় প্রতিটি রোগীরই একইসঙ্গে মাথায় আঘাত, ভাঙ্গা পাঁজর, ভাঙ্গা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। কখনও কখনও একটি বা দুটো চোখই থাকে না। যত ধরনের আঘাত কল্পনা করা সম্ভব তার সবই আপনি আমাদের হাসপাতালে দেখতে পাবেন।”

তিনি বলেন, কোনও কোনও রোগী এতো বেশি আঘাত পান যে তার জন্য পাঁচজন বা তার বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়।

কাজ চালিয়ে যাওয়া অনেক চিকিৎসক তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তাদের একজন উত্তর গাজার ডা. সালহা। তার পরিবার দক্ষিণ গাজায় পালিয়ে গেছে।

ডা. সালহা বলেন, “আমার পরিবার তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আমার কাছ থেকে দূরে রয়েছে। তবে আমার সান্ত্বনা হলো যে, আমি এখানে শিশু, নারী ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা এবং তাদের জীবন বাঁচাতে কাজ করছি।”

দীর্ঘমেয়াদী রোগীদের কোনও জায়গা নেই

চিকিৎসকরা বিবিসিকে বলেছেন, যাদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা দরকার এমন রোগীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন।

ডা. আল-আক্কাদ বলেন, “রোগীদের বেশিদিন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তাদের ফলোআপও করা যাচ্ছে না। যার সপ্তাহে চারবার ডায়ালাইসিস দরকার তিনি হয়তো তা সপ্তাহে মাত্র একবার এবং ১৬ ঘণ্টার জায়গায় মাত্র এক ঘণ্টা চিকিৎসা পাচ্ছেন।”

অনেক নারীকে চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই তাঁবুতে সন্তান প্রসব করতে হচ্ছে। ধাত্রীসেবা দেওয়া হাসপাতালগুলো বলছে, তাদের ক্ষমতা সীমিত।

চেতনানাশক ছাড়া এর আগে সিজারিয়ান অপারেশনও হয়েছে।

উদ্বাস্তু শিবিরে গাদাগাদি করে ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে বসবাসের কারণেও রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।

দক্ষিণ গাজার রাফায় উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করা ৫৪ বছর বয়সী আবু খলিল বলেন, “রোগ আছে। কিন্তু আমরা কোনও চিকিৎসা পাচ্ছি না।

“চিকিৎসার জন্য ভোর থেকে লাইন ধরতে হয়। তাও অন্তত ১০০ জনের পেছনে পড়তে হয়। প্রায়ই খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।”

রাফায় স্থল অভিযানের হুমকি ইসরায়েলের

এমন মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যেই রাফায় স্থল অভিযান চালানোর হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ রবিবার এ হুমকি দিয়ে বলেন, হামাস ১০ মার্চের মধ্যে সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি না দিলে রাফায় স্থল অভিযান চালানো হবে।

রাফায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গত দুই সপ্তাহ ধরে উদ্বেগ চলছে। সেই উদ্বেগের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল রাফায় সম্ভাব্য অভিযানের সময় ঘোষণা করল।

মিশর সীমান্তবর্তী গাজার দক্ষিণের ছোট শহর রাফা। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর গোটা গাজার বাস্তুচ্যুতরা ভিড় করেছে শহরটিতে।

৬৪ বর্গ কিলোমিটারের শহরটিতে এখন প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বাস, যেখানে গাজার মোট জনসংখ্যাই প্রায় ২৩ লাখ।

ইসরায়েলের এই সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সপ্তাহে দুবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেন।

জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরব, জর্ডান ও মিশর ইসরায়েলের রাফা অভিযানের পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে।

সব পক্ষই সতর্ক করে বলছে, রাফায় হামলা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার শঙ্কাও করা হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত