ইসরায়েল এবার হামাসকে পরাস্ত করতে গাজাকে প্লাবিত করার রাস্তায় হাটছে। গাজার ভূগর্ভস্থ টানেলে পাম্পের সাহায্যে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। পরিবেশবিদরা এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী বলছেন। তাদের মতে, এতে গাজায় দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংবাদমাধ্যমগুলো ধারণা করছে, ইসরায়েল গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই পানি প্রবেশ করাচ্ছে টানেলে। তবে এবিষয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে জো বাইডেনকে প্রশ্ন করেও কোনও সদুত্তর মেলেনি।
কিন্তু গত বুধবার সোশাল মিডিয়া এক্সে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতি দেয়। সেখানে তারা হামাসের জটিল টানেল নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ‘নতুন শক্তি’ প্রয়োগ করার কথা জানিয়েছে। টানেলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পানি প্রবেশ করানোকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
ইসরায়েল গাজায় গত চার মাস ধরে নির্বিচারে বোমা হামলা করে ২৭ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করছে, হামাস তাদের ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুত করেছে। এছাড়াও সেখানে অপহৃত ইসরায়েলিদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলেও দাবি তেল আবিবের।
জিম্মিদের উদ্ধারেই মূলত টানেলে পানি প্রবেশ করাচ্ছে ইসরায়েল। এতে গাজার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
বন্যার প্রক্রিয়া
গত ডিসেম্বরের শুরুতে একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল প্রায় পাঁচ থেকে সাতটি বড় পাম্প দিয়ে গাজার টানেল সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত করার পরিকল্পনা করছে।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, ইসরায়েলি বাহিনী শাতি শরণার্থী শিবিরের উত্তরে পাম্প বসিয়েছিল। সেখানে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাস্তুচ্যুতরা আশ্রয় নিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাম্পগুলো হাজার হাজার ঘনমিটার সমুদ্রের পানি তুলতে পারে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানেও পাম্প দিয়ে পানি প্রবেশ করানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এবিসি নিউজ জানায়, পানি প্রবেশ করানোর পর প্রাথমিক বন্যার মাত্রা সীমিত ছিল। কারণ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তখন এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর তা মূল্যায়ন করছিল।
হামাসের দাবি, তাদের টানেলগুলো প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের মাঝে তারা ভূগর্ভস্থ পথ ব্যবহার করে। ফিলিস্তিনিরা এই নেটওয়ার্ক দিয়ে খাবার, পণ্য, ওষুধ এবং ‘অস্ত্র’ পাচার করে।
গাজা ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলি বিমান, স্থল ও সমুদ্রে অবরোধের মুখে রয়েছে। ১০ কিলোমিটার চওড়া ও ৪১ কিলোমিটার লম্বায় ভূখণ্ডটিতে কী প্রবেশ করবে বা বের হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয় তেল আবিব।
পানি সরবরাহে প্রভাব
পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলছেন, টানেল প্লাবিত করলে গাজার ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের সঙ্গে যুক্ত অনেক জলাশয়ের ক্ষতি হবে। এসব জলাশয়ের উপর সেখানকার ২৩ লাখ মানুষ নির্ভরশীল।
জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মার্ক জেইতুন আল জাজিরাকে বলেন, “গাজার মাটি বালুকাময় ও ছিদ্রযুক্ত। সেখানে টানেলে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করালে মিঠা পানির উৎস নষ্ট হতে পারে। এতে সেচ, পানীয় ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত পানি দূষিত হতে পারে।”
জেইতুন একসময় গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে পানি প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার মতে, ইসরায়েল পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তার মতো অনেকেই গত ডিসেম্বর থেকে সতর্ক করে আসছেন যে, ইসরায়েলি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ‘বিপর্যয়কর’ পরিণতি হতে পারে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বুধবারের বিবৃতিকে উল্লেখ করে জেইতুন বলেন, “আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। লবণাক্ত জল প্রবেশ করালে অবশ্যই জলাধার দূষিত হবে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি ভোগ করতে হবে।
“এটি গাজার জীবনযাত্রার মান নষ্ট করবে। আমরা যদি এমন আচরণের প্রতিক্রিয়া না জানাই, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য কোনও দেশকে অন্য কোনও গোষ্ঠীর সঙ্গে এমনটা করতে বাধা দেবে কি?”
ঝুঁকিতে ফিলিস্তিনিরা
গাজা ও পশ্চিম তীরের পানির অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই ভঙ্গুর। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত গত ৯ অক্টোবর খাদ্য ও জলের উপর নিষেধাজ্ঞাসহ গাজাকে ‘সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ’ করার নির্দেশ দেন।
কয়েক দশক ধরেই ইসরায়েল তার অধিকৃত অঞ্চলে পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ইচ্ছামতো তা বন্ধ বা চালু করছে। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে নতুন পানির কূপ বা এ সংক্রান্ত স্থাপনা নির্মাণ করতে হয়।
এমনকি পশ্চিম তীরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের উপরও নজরদারি করা হয়। এছাড়া ইসরায়েলি সেনা ও দখলদাররা ফিলিস্তিনিদের পানি সরবরাহকারী অবকাঠামোতে প্রায়ই হামলা করে।
ইসরায়েলি প্রাচীর ও পশ্চিমে সমুদ্রবেষ্টিত গাজায় পানীয়, রান্নার জন্য বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। সেখানকার বাসিন্দারা তিনটি সামুদ্রিক পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট, ইসরায়েল থেকে আসা তিনটি পাইপলাইন, কূপ এবং মিশর থেকে আমদানি করা পানির উপর নির্ভরশীল।
এই সমস্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশন দূষণ। গাজার কর্তৃপক্ষ সাধারণত চারটি বর্জ্যপানি শোধনাগার ব্যবহার করে, যাতে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে নর্দমা না মেশে। ২০১৭ সালেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, গাজার পানি সরবরাহের ৯৫ শতাংশই দূষিত।
গাজার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ৭ অক্টোবর থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটও সেখানে প্রকট। ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পানযোগ্য করার দুটি প্লান্ট বন্ধ হয়ে গেছে। ইসরায়েল তার পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহও কমিয়েছে। পাম্পের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের অভাবে অনেক বোরহোল আর কাজ করে না।
অলাভজনক ক্লাইমেট রিফিউজিস সংস্থার পরিচালক আমালি টাওয়ার বলেন, “গাজা একটি দূষিত ও বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল। এটি আরও বেশি বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসছে।
“ধ্বংসস্তূপের নিচে পঁচে যাচ্ছে হাজার হাজার অনাবিষ্কৃত লাশ। বর্তমান এবং পূর্ববর্তী যুদ্ধের হাজার হাজার বিস্ফোরক বায়ু ও মাটিকে দূষিত করছে। এর মধ্যে রয়েছে সাদা ফসফরাস। এটি গাজার বাতাস ও মাটিতে আরেকটি বিষাক্ত স্তর তৈরি করেছে।”
গাজার পানি নিরাপত্তার কী হবে
কোনও জাতিগোষ্ঠী, যেমন ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করতে তাদের জীবনযাত্রার মান খারাপ করে দিলে তা আইনের চোখে অপরাধ।
অধ্যাপক জেইতুনের ভাষায়, গাজায় যা ঘটছে তা সহ্যের অতীত।
তিনি বলেন, “গণহত্যা কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুসারে আমি মনে করি, জলাধারে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করালে পানির প্রধান উৎসের ক্ষতি হবে। এটি অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়বে।”
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা গণহত্যা মামলার রায় দেয় আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। এতে তেল আবিবকে গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ইসরায়েল এর কোনও নির্দেশনাই পালন করছে না।
এদিকে গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষ লবণাক্ত, অপরিশোধিত পানি পানে বাধ্য হচ্ছে। পানি ও স্যানিটারি প্যাডের অভাবে ঋতুস্রাব পিছিয়ে দিতে নারীরা বড়ি খাচ্ছেন। পানিবাহিত রোগও বেড়েছে অনেক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গাজায় আমাশয়ে আক্রান্তের সংখ্যা অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ২৫ গুণ বেড়েছে। এক লাখেরও বেশি কেস রেকর্ড করা হয়েছে। এই রোগে আক্রান্তের অর্ধেকই শিশু, কারণ তাদের এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা