যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে জন্ম নেওয়া একমাস বয়সী শিশুটি বাবা-মায়ের আলিঙ্গন কেমন তা জানতে পারেনি। জন্মের পর থেকেই মেয়েটি গাজার দেইর আল-বালাহের আল-আকসা হাসপাতালের ইনকিউবেটরে শুয়ে আছে।
তার মা হান্না ইসরায়েলের বিমান হামলায় ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পর সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশুটির জন্ম হয়। মেয়ের নাম রাখা অবদি বেঁচে থাকতে পারেননি হান্না।
শিশুটির যত্নে থাকা নার্স ওয়ারদা আল-আওদা বলেন, “আমরা তাকে শুধু হান্না আবু আমশার মেয়ে বলে ডাকি।”
যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা এবং পরিবারের সব সদস্য নিহত হওয়ায় চিকিৎসক ও উদ্ধারকারীরা প্রায়ই এতিম শিশুদের যত্ন নেওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পান না।
নার্স ওয়ারদা আল-আওদা বিবিসিকে বলেন, “শিশুটির পরিবারের আর কারও সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। তার আত্মীয়-স্বজন কেউ আসেনি। তার বাবার কী হয়েছে তাও আমরা জানি না।”
গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। কিন্তু যুদ্ধের নৃশংসতায় তাদের জীবন এখন বিপর্যস্ত।
ইসরায়েল যদিও বলছে যে, হামলার আগে সরে যাওয়ার আদেশ দেওয়া সহ বেসামরিক মানুষ হতাহতের ঘটনা এড়াতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়েলের হামলায় ১১ হাজার ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ ছাড়া আরও বহু শিশু এমনভাবে আহত হয়েছে যে, তারা আর স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারবে না।
গাজায় যুদ্ধে এতিম হওয়া শিশুর সংখ্যা ঠিক কতো তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে ইউরো-মেডিটারেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার ২৪ হাজারেরও বেশি শিশু বাবা-মায়ের কোনও একজন বা দুজনকেই হারিয়েছে।
মাত্র ১০ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু মুস তার বাড়িতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করার সময় পায়ে ও পেটে গুরুতর আঘাত পায়। কিন্তু তার কান্না এখন তার মৃত মা, দাদা ও বোনের জন্য।
ইব্রাহিম বলেছে, “হাসপাতালের লোকেরা আমাকে বলে যে, ওপরের তলায় তাদের চিকিৎসা করা হচ্ছে।
“কিন্তু বাবার ফোনের ছবি দেখে আমি সত্যটা জানতে পারি। আমি এতোটাই জোরে কেঁদেছিলাম যে আমার পুরো শরীরে ব্যাথা পাই।” এসময় ইব্রাহিমের বাবা পাশে বসে তার হাত ধরে রেখেছিলেন।
মধ্য গাজার একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া হুসেন পরিবারের চাচাতো ভাই-বোনেরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন তারা বালুকাময় কবরের পাশে বসে থাকে, যেখানে তাদের আত্মীয়দের দাফন করা হয়। এই পরিবারের প্রতিটি শিশু বাবা-মায়ের একজন অথবা দুজনকেই হারিয়েছে।
আল-বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা আবেদ হুসেন বলে, “মিসাইলটি আমার মায়ের কোলে এসে পড়েছিল। এরপর সেটির বিস্ফোরণে তার দেহ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে তার শরীরের অংশগুলো উদ্ধার করতে আমাদের কয়েকদিন লেগে যায়।”
আবেদ বলে, “আমার ভাই, আমার চাচা ও পুরো পরিবারের নিহত হওয়ার খবর শোনার পর আমার মনে হচ্ছিল, আমার হৃদয় পুড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে।”
ইসরায়েলের বোমা হামলার শব্দে এবং পরিবার পরিজন হারিয়ে নিঃসঙ্গ বোধ করায় আবেদ হুসেন প্রায়ই রাতে ঘুমাতে পারে না। এতে তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।
আবেদ বলে, “মা-বাবা বেঁচে থাকতে আমি ঘুমাতে পারতাম। আমি আমার বাবার পাশে ঘুমাতাম। কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় তারা নিহত হওয়ার পর আমি আর ঘুমাতে পারি না।”
আবেদ ও তার বেঁচে থাকা দুই ভাই-বোনকে এখন তার দাদি দেখাশোনা করছেন। কিন্তু প্রতিদিনই তাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
আবেদ বলে, “কোনও খাবার বা পানি নেই। সমুদ্রের পানি পান করে আমার পেটে ব্যাথা শুরু হয়েছে।”
রুটি বানাতে ময়দা আনতে গিয়ে নিহত হন কিনজা হোসেনের বাবা। একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত হওয়ার পর তার বাবার মৃতদেহ দাফনের জন্য বাড়িতে আনা হয়েছিল। তারা বাবার দেহ এতোটাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে, সে তা এখনও ভুলতে পারেনি।
কিনজা বলে, “বাবার চোখগুলো উড়ে গিয়েছিল। জিহ্বাটা কাটা ছিল। আমরা এখনই এই যুদ্ধের শেষ চাই। যুদ্ধের কারণে জীবনটা পুরোপুরি বিষাদে ভরে গেছে।”
গাজার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই এখন জীবন বাঁচানোর জন্য ত্রাণ সংস্থার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যাদের অনেকেই আবার বেঁচে থাকার জন্য বারবার স্থান বদল করতে বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো সেই ১৯ হাজার শিশুকে নিয়ে যারা এতিম বা একা। তাদের দেখাশোনা করার জন্য কোনও প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়-স্বজন নেই।
ইউনিসেফ প্যালেস্টাইনের প্রধান মুখপাত্র জোনাথন ক্রিক দক্ষিণ গাজার রাফা থেকে বিবিসিকে বলেন, “এসব শিশুর অনেককে ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া গেছে বা তাদের বাড়িতে বোমা হামলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। অনেককে ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট, হাসপাতাল ও রাস্তায় পাওয়া গেছে।
“ছোট শিশুদের বেশিরভাগই নিজের ও পরিবারের কারও নাম বলতে পারে না। এমনকি বড় শিশুদের একটা অংশও বাবা-মাকে হারিয়ে হতবাক হয়ে যাওয়ায় নিজেদের পরিচয় ভুলে গেছে। তাই তাদের পরিচয় শনাক্ত করা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে বের করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।”
এমনকি কারও আত্মীয়-স্বজন খুঁজে পাওয়া গেলেও দেখা যায় যে, তারা এই এতিম শিশুদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
ক্রিক বলেন, “তারা নিজেরাই এতোটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে আছেন যে, ইচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে বাড়তি কোনও শিশুর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হয় না।
“আরও দেখা যায় যে, তাদের হয়তো নিজেদেরই সন্তান আছে যত্ন নেওয়ার জন্য। ফলে অসম্ভব না হলেও তাদের পক্ষে এই বাবা-মা হারানো শিশুদের যত্ন নেওয়া কঠিন।”
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করা স্থানীয় অলাভজনক সংস্থা এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজ বলেছে, তারা এমন ৫৫টি শিশুর দায়িত্ব নিয়েছে, যাদের বয়স ১০ বছরের কম। তারা শিশুদের মানসিকভাবে সাহায্যের জন্য রাফার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাড়তি সংখ্যক বিশেষজ্ঞ কর্মীও নিয়োগ করেছে।
এসওএস এর একজন সিনিয়র কর্মী বিবিসিকে চার বছর বয়সী একটি শিশুর কথা বলেন, যাকে রাফাহর একটি চেকপয়েন্টে রেখে যাওয়া হয়েছিল। শিশুটি সিলেক্টিভ মিউটিজম নামে উদ্বেগজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল। সে তার ও তার পরিবারের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে তা বলতে পারেনি। তবে খেলনা উপহার দিয়ে আদর-যত্ন এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা-ধুলা করার পর তার মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
ইউনিসেফের বিশ্বাস, গাজার প্রায় সব শিশুরই এখন মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দরকার। যুদ্ধে তাদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাদের এতোটাই ক্ষতি হয়েছে যে, এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তাদের বহুদিন ধরে লড়াই করতে হবে।