Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

আয়ু কি লেখা থাকে মানুষের জিনে!

gene-250324
[publishpress_authors_box]

এক সময় বাংলা সিনেমায় চূড়ান্ত নাটকীয় দৃশ্যে সন্তানের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে অমিল হলে পিতৃ পরিচয় নতুন মোড় নিতো। এখন সিনেমায় এমন দৃশ্য দেখলে যে কারো হাসি পাবে। কারণ এখন পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ বা জেনেটিক পরীক্ষা থেকে বায়োলজিকাল সম্পর্ক নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে।

২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় চারজন পুড়ে যান। পোড়া লাশ দেখে পরিচয় শনাক্ত করার উপায় ছিল না। তখন স্বজন পরিচয় দেওয়া পরিবারের সদস্য ও পুড়ে যাওয়া মরদেহের ডিএনএর নমুনা তুলনা করে দেখা হয় সিআইডির ল্যাবে। মৃতদের ডিএনএ এবং স্বজন দাবিদারদের ডিএনএ নমুনা মিলে গেলে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।

ফরেনসিক বিজ্ঞান বা অপরাধ বিজ্ঞানেও ডিএনএ পরীক্ষা খুনির কাছে পৌঁছানোর পথ দেখাচ্ছে।  

সুইডিশ বিজ্ঞানী স্ভান্তে প্যাবো ২০২২ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রাচীন ডিএনএ পরীক্ষা করে নিয়ান্ডারথালের জিনোম বিন্যাস প্রকাশ করেন এই বিজ্ঞানী; যা জীবাশ্মের জিন নিয়ে বিজ্ঞানের নতুন দিক খুলে দিয়েছে।

নিয়ানডার্থাল হয়তো ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু দেহবশেষ থেকে নিয়ানডার্থালদের জিন বিন্যাস উন্মোচন করেন  এই বিজ্ঞানী।

স্ভান্তে প্যাবোর পরীক্ষা বলছে,  ৭০ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির জিনের মিলন ঘটেছিল।  

নিয়ান্ডারথাল জিনের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মিলবে আধুনিক মানুষের শরীরে; এই কথাও বলছে তার গবেষণা।

স্তন ক্যান্সারে মা মারা যাওয়ার পর সতর্ক থাকতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন হলিউড অভিনয় শিল্পী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। দেখা গেল ক্যানসারের প্রভাবক বিআরসিএ১ জিন রয়েছে তার শরীরে; যার কারণে জোলির স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ছিল ৮৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য পরীক্ষার এই ফল জেনে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সুস্থ জীবন নিশ্চিতে স্তন কেটে ফেলেন জোলি।    

জিন, জেনেটিকস, জিনতত্ত্ব, জিনোম, জিনতত্ত্ববিদ – এতো সব ইংরেজি ও বাংলা শব্দের সমাহার বলে দেয় জীববিজ্ঞানের বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব শাখা দিনে দিনে কতটা প্রসারিত হয়েছে। মেডিকেল পরীক্ষা থেকে গবেষণায় মানুষের শরীর-বংশগতি থেকে মানবজাতির ইতিহাসেও আলো ফেলছে জিন। কারণ মানব ডিএনএতে থাকা জিন অণুতে লেখা থাকে বংশ ধারাবাহিকতার বৈশিষ্ট্য ।

ইংরেজিতে জেনেটিকস শব্দের আগমন আগে ঘটেছিল। উইলিয়াম বেটসন ১৯০৫ সালে এই শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটান। এরপর ১৯০৯ সালে উদ্ভিদবিদ উইলহেম জোহানসেন প্রথম জিন শব্দের প্রয়োগ করেন।    

অন্তত এক যুগ আগেও গবেষকদের মনে প্রশ্ন ছিল, জিন কি জানে কেউ অসুখে মারা যাবে নাকি বয়স জনিত কারণে?  

জিন একটি গ্রিক শব্দ। গ্রিক মিথ অনুসারে, জন্মের সময় চরকায় সুতা কাটা হতো। আর ওই সুতার দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করতো মানুষের আয়ু।

আধুনিক জিনতত্ত্ব বলছে, গ্রিক সময়ের ওই ধারণা অমূলক ছিল না।

ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে থাকে ডিএনএ বিন্যাস ও প্রোটিন দিয়ে তৈরি টেলোমিয়ার; যা জিন ক্ষয় রোধ করে। এই টেলোমিয়ার না থাকলে জিন তথ্য জমা করে রাখতে পারতো না। যে স্তরের প্রাণীই হোক না কেন, কোষ বিভাজনের জন্য  টেলোমিয়ার জরুরি। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় টেলোমিয়ার একটু আকারে খর্ব হয়ে আসে। টেলোমিয়ার খুব ছোট হয়ে গেলে, কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াও থমকে যায় এবং মারা যায়। প্রাণীর বুড়িয়ে যাওয়া, ক্যানসার এবং মৃত্যু ঝুঁকির পেছনে কাজ করে এই প্রক্রিয়া।  

মানব শবীরের ৪৬টি ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে থাকে টেলোমিয়ার। জন্মের সময় টেলোমিয়ার যথেষ্ট দীর্ঘ থাকে। তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের বেলায় টেলোমিয়ার খাটো হয়।আর এ কারণে বিজ্ঞানীরা মনে করতে শুরু করেন, দীর্ঘজীবন ও সুস্থ শরীরের চিহ্ন হলো এই টেলোমিয়ার।   

শরীরের বয়স বনাম আসল বয়স  

২০১৫ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ‘বায়োলজিকাল ক্লক এইজ’ অর্থাৎ দেহঘড়ির বয়স নিয়ে কাজ করা হয়। পাঁচ হাজার অংশগ্রহণকারী নিয়ে ওই গবেষণায় মানুষের জীবদ্দশায় ডিএনএতে হওয়া রাসায়নিক পরিবর্তনে গভীর নজর রাখা হয়। আর এতে জানা সম্ভব হয় আসল বয়স এবং জিনের অবস্থা অনুসারে বয়সের পার্থক্য।   

যারা দীর্ঘদিন ধরে কোনো অসুখে ভুগছেন অথবা যারা ধূমপান করেন তাদের বেলায় ডিএনএ ঘড়িতে দ্রুত বয়স বাড়তে থাকে। ফলে মৃত্যুর সময়ও দ্রুত ঘনিয়ে আসে।

২০১৮ সালে নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত এক গবেষণা দাবি করেছে, মারা যাওয়ার পরও কোনো কোনো জিন পুরোপুরি সক্রিয় থাকে।

এদিকে ২০২৩ সালে প্রকাশ পাওয়া এক গবেষণা দাবি করছে, যাদের জিন কম বয়সে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা ধারণ করে তারা ৭৬ বছর বয়সের আগেই মারা যেতে পারেন।

এই গবেষণায় দুই লাখ ৭৬ হাজার ৪০৬ জনের জিন সংগ্রহ করা হয়েছিল ইউকে বায়োব্যাংক থেকে। অংশগ্রহণকারীদের সবাই ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন এবং ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে জন্মেছিলেন।

৬০ লাখ ডলার নির্মাণ ব্যয়ে দুবাই শহরে ২০২২ সালে চালু হয়েছে দান্তে ল্যাব; যারা বার করেছে ডিএনএ টেস্টিং কিট। এই ডিভাইস কিনতে খরচ হবে ৯৯৯ দিরহাম বা ২৭০ ডলার। এই ডিএনএ টেস্টিং কিট দিয়ে জানা যাবে, ভবিষ্যতে শরীরে কী রোগ বাসা বাঁধতে পারে। বাড়িতে এই কিট এনে ওতে থাকা চার মিলিলিটারের শিশিতে স্যালাইভা বা লালা ভরাতে হবে।এরপর সেই শিশি পাঠিয়ে দিতে হবে দান্তে ল্যাবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে জানা যাবে শরীরে ক্যানসার, ডায়াবেটিক, স্থূলতা জীবনে কাল হয়ে আসবে কি না। দান্তে ল্যাব প্রতি সপ্তাহে এক হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম।

বিজ্ঞানীরাও এও দেখেছেন, একজন ব্যক্তি কোন সময় মারা যাবেন এমন তথ্যও রয়েছে জিনে।

২০১২ সালে, বেথ ইসরয়েল ডিকনেস মেডিকেল সেন্টার (বিআইডিএমসি) দাবি করে, সকাল সকাল ঘুম ভাঙার অভ্যাস থাকা অথবা পেঁচার মতো রাত জাগার স্বভাবও আসলে জিনে লেখা থাকে।

ওই গবেষক দলের পর্যবেক্ষণ আরও বলছিল, গড়পড়তা ভাবে মানুষ সকাল ১১টার মধ্যে মারা যায়।

২০১২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এই গবেষণা অংশগ্রহণকারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ‘এ-এ’ জিন থাকা লোকেরা ‘জি-জি’ জিন থাকাদের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।

আর এই ধরনের জিন থেকে জানা যায় মৃত্যুর মুহূর্তও! যেমন- ‘এ-এ’ অথবা ‘এ-জি’ জিন থাকা লোকেরা সকাল ১১টার আগেই মারা যান। আর যাদের ‘জি-জি’ জিন রয়েছে তারা সন্ধ্যা ৬টার আগে মারা যান।

জিন থেকে অসুখে মৃত্যু হবে কি না জানা যাচ্ছে, মৃত্যুর সম্ভাব্য বয়স জানা যাচ্ছে। এমনকি মৃত্যুর সময় নিয়েও ধারণা মিলছে।

তবে মৃত্যুর তারিখ দিয়ে জিন থেকে এখনও কিছু জানা যায়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত