ভেবেছিলাম, বাধা দিলেই বাধবে লড়াইয়ের দিন বুঝি শেষ। মনে হচ্ছিল প্রতিবাদ প্রতিরোধের সংস্কৃতিকে বিদায় জানিয়ে গৃহকোণে ঠাঁই নিয়েছে জার্মানরা। তাদের ভিতরে উত্তাপ যেন আর নেই। কিন্তু গত কয়েকদিনে সবিস্ময়ে যা দেখলাম তার ফলে ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো আমার ধারণা। উঠে দাঁড়িয়েছে বিবেকী মানুষরা — হাজার হাজার মানুষ। তারা বলছে, উগ্র দক্ষিণপন্থা, মানববৈরী নাৎসি ধ্যানধারণা প্রতিরোধ করতে একজোট হও। বলছে, আর বসে থাকা নয়। জোর গলায় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দাও আমরা তোমাদের চাই না চাই না চাই না। ২০/২১ জানুয়ারি গোটা জার্মানির ছোট বড় নানা শহরে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, প্রতিরোধ সমাবেশে অংশ নিয়েছে।
কিন্তু কেন এই গণমিছিল? সাম্প্রতিক এক ঘটনার প্রেক্ষাপটেই রাস্তায় নেমেছে এদেশের হাজার হাজার মানুষ। রাজধানী বার্লিনের অদূরে ছোট্ট ব্রান্ডেনবুর্গ রাজ্যের রাজধানী শহর পৎসডাম, যেখানকার সেসিলিয়ানহোফ রাজপ্রাসাদে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েৎ ইউনিয়ন আর ব্রিটেনের তিন শীর্ষ নেতা হ্যারি এস ট্রুম্যান, জোসেফ স্টালিন আর উইনস্টন চার্চিল পরাজিত জার্মানির বিভক্তির ব্যাপারে একমত হন। ঊনআশি বছর পর সেই পৎসডামেরই কাছে একটা হোটলে গত ২৫ নভেম্বর সমবেত হয়েছিল জার্মানির উগ্র দক্ষিণপন্থী মহলের জনা পঁচিশ কট্টর প্রতিনিধি। এবং তারা এদেশে আশ্রয় পাওয়া মানুষ, এমনকি জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়া বিদেশিদেরও বিপুল সংখ্যায় জার্মানি থেকে বিতাড়িত করার এক মাস্টার প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠকটি ছিল খুবই গোপন। চুপিসারে তা সেরে ফেলতে চেয়েছিল উদ্যোক্তারা। কিন্তু খবরটা শেষ পর্যন্ত ফাঁস হয়ে গেছে এবং তা তোপের মতো কাজ করেছে।
পৎসডামের এই গোপন বৈঠকটির আনুপুঙ্খিক খবর বের করেছে ‘কারেক্টিভ’ (Corrective) নামের একটি সংস্থা। তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এদের সুনাম আছে। এদের লক্ষ্য — সমাজের স্বার্থে তদন্তমূলক সাংবাদিকতার কাজ করে যাওয়া। এ পর্যন্ত বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে এই মিডিয়া সংস্থা। ‘কারেকটিভ’-এর ভাষ্য অনুযায়ী পৎসডামের গোপন বৈঠকে অংশ নিয়েছে যারা তাদের অনেকেই জার্মান ফেডারেল পার্লামেন্ট ‘বুন্ডেস্টাগ’-এ আসীন দক্ষিণপন্থী দল Alternative for Germany (AFD)-এর সদস্য। ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের ধারক বলে পরিচিত আইডেন্টিটারিয়ান আন্দোলনের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা অস্ট্রিয়ার মার্টিন জেলনারও উপস্থিত ছিল বলে কারেক্টিভ জানিয়েছে। আইডেন্টিটারিয়ান আন্দোলনের প্রবক্তারা এক ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা বলে থাকে।পশ্চিমের শ্বেতকায় জনসংখ্যাকে সরিয়ে অশ্বেতকায়রা তাদের স্থান গ্রহণ করবে, এরকম একটা ষড়যন্ত্র চলছে বলে তারা মনে করে। এই জেলনার যুবাবয়স থেকেই উগ্র দক্ষিণপন্থী কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়। তারই উপর দায়িত্ব পড়েছিল বিদেশি বিতাড়নের মাস্টার প্ল্যান বৈঠকে পেশ করার এবং তা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর।
বৈঠকে উপস্থিত ছিল যারা কারেক্টিভ তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, জার্মানির মধ্যডান খ্রিস্টীয় গণতন্ত্রী ইউনিয়ন CDU দলের সঙ্গে সম্পর্কিত কট্টর রক্ষণশীল গোষ্ঠী ভেয়ার্টে ইউনিয়ন (WerteUnion)-এর দুজন সদস্যও বৈঠকে ছিল। এ ছাড়াও ছিল জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অতি রক্ষণশীল ‘ফ্র্যাটার্নিটি বুর্শেনশাফ্ট’-এর সদস্য, ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা, উকিল, ডাক্তার। এদের সবারই উগ্র দক্ষিণপন্থী মহলে ঘোরাফেরা করার কথা বলা হয়েছে। বৈঠকের দুজন আমন্ত্রণকারীর কথা জানিয়েছে কারেক্টিভ। তাদের একজন একসময় দাঁতের ডাক্তারি করত — আর একজনের রেস্তোরাঁ ব্যবসায় বেশ নাম আছে।
মাস্টার প্ল্যানের উপস্থাপক মার্টিন জেলনার বিদেশি তাড়ানোর পরিকল্পনার সূত্রে এই মত প্রকাশ করে যে আশ্রয়প্রার্থী, এদেশে স্থায়ীভাবে থাকার পার্মিটধারী বিদেশি এবং সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে না যাওয়া নাগরিকদের, সে তাদের জার্মান পাসপোর্ট থাক বা না থাক, এই দেশ থেকে বার করে দিতে হবে। বিতাড়নের একটি বিকল্প হিসাবে উত্তর আফ্রিকার একটি দেশের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বিশ লাখের মতো লোককে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এটাকে তারা বলছে ‘re-immigration’ বা ‘পুনরভিবাসন’।
২.
উগ্র দক্ষিণপন্থী মহলের এই ঢালাও বিদেশি বিতাড়নের মহাপরিকল্পনার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর চমকে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো, খোদ বার্লিন সরকারের শীর্ষ প্রতিনিধিরা, সাধারণ মানুষও। শুরু হয়ে গেছে শহরে শহরে প্রতিবাদ সভা, গণমিছিল। বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিখ, কোলন, ডর্টমুন্ড, ডুসেলডর্ফ, স্টুটগার্ট, মানহাইম কোনও শহরই পিছিয়ে থাকছে না। এমনকি ছোট ছোট শহরগুলোতেও মানুষ মিছিল করছে — উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে, নব্য নাৎসিদের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার।
২০ জানুয়ারি বিশ্বিবিদ্যালয় শহর হাইডেলবার্গেও অন্তত বিশ হাজার মানুষ যোগ দেয় মিছিলে। শ্লোগান তোলে — নাৎসিরা নিপাত যাক — গণতন্ত্র রক্ষা করো — উগ্র দক্ষিণপন্থাকে রুখে দাঁড়াও। দক্ষিণপন্থী AFD দলের বিরুদ্ধেও জোরালো স্লোগান শোনা গেছে। এই সব প্রতিবাদ সভা আর মিছিলের ডাক দিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, চার্চের সঙ্গে সংযুক্ত নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ‘এসপিডি’, সবুজ দল (গ্রিন পার্টি), বাম দল ও সমমনা সংগঠনগুলো। হাইডেলবার্গের ট্রামে চোখে পড়লো এমন সব যাত্রী যারা প্রতিবাদ সমাবেশ আর মিছিলে অংশ নিতে যাচ্ছিল। এক নারী যাত্রীর কাপড়ের ব্যাগের উপর AFD দলকে কটাক্ষ করে লেখা — বর্ণবাদ কোনওক্রমেই কোনও বিকল্প নয়।
দক্ষিণপন্থী বলে পরিচিত এই দলটি এখন বিপাকে পড়েছে। বারবারই তাদের নেতাদের বলতে হচ্ছে, আমরা মোটেই উগ্র দক্ষিণপন্থী নই। পৎসডামের গোপন বৈঠকে অংশ নিয়েছিল যারা তাদের মধ্যে ছিল AFD দলের সভাপতি অ্যালিস ভাইডেলের একজন উপদেষ্টা। গোপন বৈঠকের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরপরই দলপ্রধান তাঁর এই উপদেষ্টাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে এই দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে আবার নতুন করে।
সামাজিক গণতন্ত্রী রাজনীতিক চ্যান্সেলর ওলাফ শলজের নেতৃত্বাধীন বর্তমান জার্মান সরকারের তিন কোয়ালিশন সহযোগী সামাজিক গণতন্ত্রী দল ‘এসপিডি’, ‘সবুজ দল’ ও লিবারেল মুক্ত গণতন্ত্রী দল ‘এফডিপি’ এবং বাম দলের ৪৯ জন সাংসদ AFD দলকে নিষিদ্ধ করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখার আবেদন করেছেন। উগ্র দক্ষিণপন্থী মহলের বিদেশি বিতাড়নের অশুভ পরিকল্পনার খবর ফাঁস হওয়ার পর ক্ষুব্ধ জার্মান চ্যান্সেলর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, যারা আমাদের মুক্ত গণতান্ত্রিক মৌল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কাজ করবে, তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার দায়িত্ব সংবিধান সুরক্ষা দপ্তর ও বিচারবিভাগের। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কে কোথা থেকে এসেছে, কার গায়ের রং কি সেকথা বিবেচনায় না এনে আমরা সকল মানুষের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকব।
৩.
বন্দর নগরী হামবুর্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে এই নগররাজ্যের শাসক মেয়র সামাজিক গণতন্ত্রী রাজনীতিক পিটার চেন্টশার AFD দলের তীব্র সমলোচনা করে বলেন, AFD ও তার দক্ষিণপন্থী নেটওয়ার্কগুলোর কাছে আমাদের বার্তা হলো: আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আমরা শক্তি আমরা বল, কেননা আমরা সংঘবদ্ধ, কেননা আমরা দৃঢ়প্রত্যয়ী যে আমাদের দেশ এবং আমাদের গণতন্ত্রকে ১৯৪৫ সালের পর আমরা দ্বিতীয়বার ধ্বংস হতে দেব না।
মধ্য-ডান বলে পরিচিত জার্মান খ্রিস্টীয় গণতন্ত্রী ইউনিয়ন ‘সিডিইউ’ ও তার সহযোগী দল বাভারিয়ার খ্রিস্টীয় সামাজিক ইউনিয়ন ‘সিএসইউ’ বর্তমান পরিস্থিতিতে একটু বেকায়দায় পড়েছে বৈকি। ‘সিডিইউ-এর দুই সদস্য, যারা কিনা দলের ঘনিষ্ঠ বলে অভিহিত কট্টর দক্ষিণপন্থী মূল্যবোধের প্রচারক WerteUnion বা Values Union Association-এরও সদস্য, পৎসডামের গোপন বৈঠকে অংশ নেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে এই দলও। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিডিইউ-এর সদস্যপদে থেকে এই ঘোর রক্ষণশীল সমিতির সদস্য থাকা যাবে না। কিন্তু AFD-র ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানতে এই দলের নেতাদের কেউ কেউ এমন সব বক্তব্য রাখেন যার সঙ্গে AFD-র অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যের খুব একটা পার্থক্য করা দুরূহ হয়ে ওঠে। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্য ব্রান্ডেনবুর্গ, থুরিঙ্গিয়া আর স্যাক্সনিতে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। এই অঞ্চলে AFD দলের পক্ষে ভোট ক্রমশই বাড়ছে। জনমত সমীক্ষার ফল বলছে, এই দল হয়ত প্রাদেশিক পরিষদে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে উদ্বেগের কারণ ঘটবে।
এই প্রবণতা রুখতে হলে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে, ঘোরতর রক্ষণশীল দল AFD-র বিরুদ্ধে এই যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামছেন, প্রতিরোধের সেই গতিধারাকে জিইয়ে রাখার দায়িত্ব জার্মানির বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের।
হাইডেলবার্গ, ২১ জানুয়ারি, ২০২৪।
লেখক: সাংবাদিক। ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক-সাংবাদিক।
ইমেইল: abdafq@protonmail.com