বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারত নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য দাবি করার পর তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। তবে এটাই প্রথম নয়, এর আগেও কয়েকটি পণ্যের জিআই নিবন্ধন করিয়েছে ভারত, যেগুলো বাংলাদেশের বলে দাবি রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে জিআই নিয়ে বাংলাদেশের লড়াই শুরুর আগেই ‘বাংলার রসগোল্লা’, ‘নকশি কাঁথা’ ও ‘মালদার ফজলি আম’ জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে নেয় ভারত।
২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি ও ইলিশকেও জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। এসব পণ্য বাংলাদেশেই বেশি প্রসিদ্ধ ছিল।
কিন্তু পণ্য জিআই নিবন্ধনের জন্য তখন বাংলাদেশে কোনো আইন ছিল না। ২০১৩ সালে আইন হওয়ার পর প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হয় জামদানি শাড়ি। তবে ভারতও জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করে, তবে তা ‘উপাধা জামদানি’ নামে।
এদিকে বাংলাদেশে এরপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরসাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের জিআই নিবন্ধন সম্পন্ন করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে জিআই স্বীকৃতি পায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা ও ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল।
অন্যদিকে সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয় গত ২ জানুয়ারি, যার জন্য আবেদন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন কর্পোরেশন।
এবার টাঙ্গাইল শাড়ি
‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে একটি পণ্যকে ভারত জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার মাস খানেক পর বাংলাদেশের তা নিয়ে শোরগোল শুরু হয় গত শুক্রবার ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ফেইসবুক পাতায় দেওয়া একটি পোস্ট নিয়ে।
ওই পোস্টে জিআই নিবন্ধন প্রাপ্তির কোনো তথ্য তুলে ধরা হয়নি। তবে এই শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরে এর বুনন ও সৌন্দর্যের গুনগান করা হয়।
বাংলাদেশে তার তীব্র সমালোচনার ওঠার মধ্যে শনিবার ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পাতা থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে পোস্ট সরানোর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত ২ জানুয়ারি ভারতের শিল্পনীতি ও উন্নয়ন বিভাগের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টিজের আওতায় জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশনস রেজিস্ট্রি কর্তৃপক্ষ ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অফ বেঙ্গল’ নামে একটি পণ্যকে নিবন্ধন দেয়।
এ সংক্রান্ত আবেদনটি করেছিল পশ্চিমবঙ্গে হস্তচালিত তাঁতিদের একটি সমবায় সমিতি। ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত আবেদন দাখিল করেন তারা। আবেদন যাচাই করে ২০৩০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের জন্য এই জিআই নিবন্ধন দেওয়া হয়।
এই নিবন্ধন দেওয়ার দুদিন পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক্স একাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে তিনি টাঙ্গাইল শাড়িসহ তিন ধরনের শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা জানান। একই সঙ্গে এই শাড়ি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের কাজের প্রশংসা করে তাদের অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানান।
টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে মধুর জিআই নিবন্ধন ভারত করে নিলেও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনও পদক্ষেপই ছিল না।
কর্মকর্তারা এখন যা বলছেন
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) জিআই পণ্যের নিবন্ধন দিয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে আবেদন করতে হয় জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে।
ডিপিডিটির প্রধান কর্মকর্তা বা মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বিদেশে থাকায় পরিচালক আলেয়া খাতুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা রবিবার তাঁত ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছি। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসককে টাঙ্গাইলের শাড়ির বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে বলেছি। আশা করছি, টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই আমাদের দেশেরই থাকবে।”
এদিন বৈঠকের পর বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধনে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আলেয়া বলেন, “টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক এলাকা। ভারত তাদের এলাকার জিআই দিতে পারে। টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই তারা দিতে পারে না।”
সুন্দরবনের মধুর বিষয়ে আলেয়া খাতুন বলেন, “সুন্দরবনের মধুর জিআই পেতে কিছুটা সময় লাগবে। ওখানকার বন বিভাগ জানিয়েছে, তাদের সক্ষমতা নেই। এ কারণে আমরা বিষয়টি অন্য জায়গায় পাঠাচ্ছি।”
ডিপিডিটির পেটেন্ট বিভাগের সহকারী পরিচালক নীহার রঞ্জন বর্মন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় কিছু তাঁতি টাঙ্গাইল থেকে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। এরপরও কেউ কেউ গেছেন। তারা যে শাড়ি তৈরি করছে, সেটাকে টাঙ্গাইল শাড়ি বলছে ভারত।
“কিন্তু জিআই হিসেবে তারা দিতে পারে না। জিআই মানে ভৌগোলিকভাবে ওই অঞ্চলের হতে হবে,” বলেন তিনি।
এনিয়ে জাতিসংঘে আপত্তি জানানোর সুযোগ আছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাইলে আন্তর্জাতিকভাবে কথা বলতে পারি। বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনে (ডাব্লিউআইপিও) আপত্তি জানানো সম্ভব। সুযোগ আছে।”
জিআই কী
যেসব পণ্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে থাকে, একই সঙ্গে আঞ্চলিকভাবে খ্যাতি রয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্য রয়েছে, এসব পণ্য জিআই সনদ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
তবে শর্ত রয়েছে, এসব পণ্যের গুণাগুণের প্রমাণ বিভিন্ন দালিলিক নথি, প্রাচীন সাহিত্য ও বিভিন্ন প্রকাশনায় থাকতে হয়। একই সঙ্গে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়।
এ জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তিকে তথ্য-উপাত্তসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরে (ডিপিডিটি) আবেদন করতে হয়। তখন তারা যাচাই-বাছাই শেষে যৌক্তিক মনে হলে সনদ দেয়।
জিআই সনদ নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক মহলে পণ্যের ব্র্যান্ডিং। জিআই নিবন্ধন থাকলে ক্রেতারা সহজেই বিশ্বাস করেন, এটা আসল পণ্য। কোনো পণ্য জিআই পণ্যের সনদ পেলে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে ওই পণ্যটা প্রকৃত গুণাগুণ সম্পন্ন।
তিন শ্রেণির পণ্যকে জিআই মর্যাদা দেওয়া হয়- কৃষি, হস্তশিল্প ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পণ্য।