Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গরুর বদলে ছাগল চেয়েছিলেন ইফাত

সাদিক এগ্রো বলছে, ছাগলের বাকি ১১ লাখ টাকা ম্যানেজ করতে না পারার কথা জানিয়ে সামারাই থেকে কেনা গরুটির বদলে ছাগলটি নিতে চেয়েছিলেন ইফাত। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সাদিক এগ্রো বলছে, ছাগলের বাকি ১১ লাখ টাকা ম্যানেজ করতে না পারার কথা জানিয়ে সামারাই থেকে কেনা গরুটির বদলে ছাগলটি নিতে চেয়েছিলেন ইফাত। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

ঘটনা গত কোরবানি ঈদের দুই মাস পরের। ঢাকার বনশ্রী এলাকার সামারাই ক্যাটেল ফার্মে যান এবারের ঈদে ‘উচ্চ বংশীয়’ ছাগল কিনতে গিয়ে ভাইরাল হওয়া তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত।

বনশ্রীর এই খামারের মালিক মো. নিলয় হোসেনের দাবি, তখন শাহীওয়াল জাতের একটি গরু পছন্দ হয় ইফাতের। তার ইচ্ছা ছিল এই কোরবানির জন্য গরুটি কিনবেন। এজন্য ৫০ হাজার টাকায় বুকিংও দেন গরুটি। কথা ছিল বাকিটা সময় পেলে দেবে সামারাই ক্যাটেল ফার্ম। সব মিলে খরচ পড়বে ৮ লাখ টাকা। তবে হঠাৎ মাস তিনেক আগে গরুটি নিয়ে যান ইফাত।

সাদিক এগ্রো বলছে, শাহীওয়াল জাতের প্রায় সাড়ে ৭০০ কেজি ওজনের ওই গরুর বদলেই তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকায় ছাগলটি নিতে চেয়েছিলেন ইফাত। সাদিক এগ্রোকে তিনি জানিয়েছিলেন, টাকা যোগাড় করতে না পারার কারণেই তার এই প্রস্তাব। সাদিক এগ্রো সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

১৭৫ কেজি ওজন, ৬২ ইঞ্চি উচ্চতার ছাগল দেশে সচরাচর দেখা যায় না। এবারের কোরবানির ঈদে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো ছাগলটি আনে; দাম হাঁকে ১৫ লাখ টাকা। এত দামের পেছনে ব্যাখ্যা ছিল উন্নত জাত ও বংশ মর্যাদা।

এই ছাগলটির ভবিষ্যৎই এখন অনিশ্চয়তায়।

১২ লাখ টাকায় ছাগলটির কিনতে চাওয়ার কথা জানিয়ে একটি পোস্ট দেন ইফাত। বায়না হিসাবে ১ লাখ টাকাও দেন তিনি। ওই ভিডিওতে তাকে হাসিমুখে বলতে শোনা যায়, “স্বপ্ন ছিল এরকম একটা খাসির। এরকম খাসি আগে কখনও দেখিনি। এই প্রথম দেখা। এটা আমার হবে জানা ছিল না। আল্লাহ নসিবে রাখছে তাই হইছে।”

সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সোশাল মিডিয়ায়। প্রশ্ন ওঠে ইফাতের এতো অর্থের উৎস নিয়ে। এর মধ্যে সেই ছাগলের রশি ধরে টান পড়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের। ইফাত তার ছেলে বলে ফেইসবুকে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। আর এই ছাগলের সঙ্গে ইফাতের নানা ব্র্যান্ডের গাড়ির ছবিও আসে ফেইসবুকে। তা ধরে মতিউর রহমানের সম্পদ নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। গণমাধ্যমে তার অঢেল সম্পদ নিয়ে খবর আসতে থাকে।

তুমুল আলোচনার মধ্যে মতিউর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ইফাত তার ছেলে নন। এদিকে ইফাতেরও দেখা পায়নি সাদিক এগ্রো। ১৭ জুন কোরবানির ঈদ হলেও ছাগলটি রয়ে গেছে সাদিক এগ্রোতে। আছে শাহীওয়াল জাতের প্রায় সাড়ে ৭০০ কেজির গরুটিও।

সামারাই ফার্মের ৮ লাখ টাকার গরু 

সামারাই ক্যাটেল ফার্মের দাবি, কথা ছিল ২০২৪ সালের কোরবানির আগে ইফাত এই গরু নেবেন। কিন্তু হঠাৎ মাস তিনেক আগে গরুটি নিয়ে যান বন্ধুর খামারে রাখার কথা বলে।

সামারাই ক্যাটেল ফার্মের মালিক নিলয় হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০২৩ সালের ঘটনা এটি। সে সময় তিনি এসে ২০২৪ সালের জন্য একটি গরু প্রি-বুকিং করেন। গত কোরবানির মাস দুয়েক পরের ঘটনা এটি।”

“সেই গরুটি গত তিন মাস আগে আমাদের কাছ থেকে ডেলিভারি নিয়ে যায়। হঠাৎ একদিন ফোন দিয়ে বলে যে, আমাদের ফার্ম তার বাসা থেকে দূরে, তাই গরুটি তার বাসার পাশে কোনও এক বন্ধুর খামারে রাখবে।”

মতিউর রহমানের সঙ্গে মুশফিকুর রহমান ইফাতের এই ছবি ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়, যা ইফাতই দিয়েছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

গরুটির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে সামারাই ক্যাটেল ফার্মের মালিক বলেন, “প্রথমে যখন প্রি বুকিং দেয় তখন আমাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল। তারপর সারা বছরে দিয়েছিল ১ লক্ষ টাকা। এটা পুরো বছর ধরে দিয়েছে। আমাদের অনেক কাস্টমারই এভাবে একটু একটু করে দেয়। গরুটির দাম ধরা হয়েছিল এক বছর পেলে ৮ লক্ষ টাকা।”

“সেই গরুটা তিনি নিয়ে যান আজ থেকে ধরেন তিন মাস আগে। আমাকে বলেছিল, তার বন্ধুর কোনও খামারে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, সে এই গরু ইমরান ভাইয়ের ফার্মে [সাদিক এগ্রো] নিয়ে গেছেন।”

রাজি হয়নি সাদিক এগ্রো

এদিকে সাদিক এগ্রো বলছে, ছাগলের বাকি ১১ লাখ টাকা যোগাড় করতে না পারার কথা জানিয়ে সামারাই থেকে কেনা গরুটির বদলে ছাগলটি নিতে চেয়েছিলেন ইফাত।

সেই প্রস্তাবে রাজি হননি দাবি করে সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ইফাত আমাদের এখানে গরুটি রেখেছিল। আমরা এভাবে মানুষের কোরবানির গরু রাখি। দেখা যায় অনেকেই গ্রামে আগে গরু কিনে ফেলে। পরে শহরে এনে রাখার জায়গা পান না। তখন তাদের জন্য শুধুমাত্র যে কয়দিন আমরা গরুটি রাখি তার জন্য একটি খরচ আমাদের দেয়। সেই হিসাবেই এই গরু রাখা হয়েছিল।

““আমি কীভাবে রাজি হই? ঈদের পশু নিয়ে এরকম করা উচিত না। আমি এটার সঙ্গে রাজি হই না। পরবর্তীতে সে আমাকে জানায়, সব টাকা দিয়েই এই গরু ও ছাগলটি নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিতর্ক তুঙ্গে উঠলে ইফাত জানিয়ে দেন, গরু-ছাগল, এমনকি বায়না করতে দেওয়া ১ লাখ টাকা কিছুই লাগবে না তার।”

গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ইফাত দাবি করেছেন, সাদিক এগ্রো থেকে ছাগল কেনেননি তিনি। তাকে মডেল হিসেবে দেখিয়েছে সাদিক অ্যাগ্রো।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান বলেন, “এ দাবি পুরাই হস্যকর।”

‘এক কোরবানিতেই ৭০ লাখ টাকার গরু’

গণমাধ্যমে খবর এসেছে, এই ঈদে রাজধানীর ঢাকা ও আশপাশের সাতটি খামার ও হাট থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন ইফাত। সাদিক এগ্রো থেকে কিনতে চেয়েছিলেন ছাগলটি।

তবে ফেইসবুকে বিতর্কের মুখে সাদিক এগ্রোতে বুকিং দেওয়া ছাগলটি তিনি নেননি। এমনকি সামরাই এগ্রোর যে গরুটি সাদিক এগ্রোতে রেখেছিলেন সেটিও নেননি। তবে অন্যান্য খামার ও গাবতলী হাট থেকে কেনা পশু তিনি ডেলিভারি নিয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সাদিক এগ্রো ছাড়া ঢাকা ও আশপাশের পরিচিত খামার এগ্রো সামারাই, রাহমাহ ক্যাটেল ফার্ম, ব্রাউনিজ, হাম্বা পাগলা এগ্রো অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম, সারা এগ্রো, বুদ্দু ক্যাটেল ফার্ম এবং গাবতলী হাট থেকে সব মিলিয়ে ৭০ লাখ টাকার পশু কিনেছিলেন।

এদের মধ্যে মোহাম্মদপুরে রাহমাহ ক্যাটেল ফার্মের মালিক মো. জিদনী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই ছেলে আমাদের কাছ থেকে গত ৪ বছর ধরেই গরু নিচ্ছেন। ওর শখ সবসময় বড় গরুর। এবারও আমাদের থেকে একটি গরু নিয়েছেন।”

ওই সাত খামারের একটি থেকে ইফাত ১৭ লাখ টাকায় একটি গরু কেনেন বলে সকাল সন্ধ্যাকে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।

গাবতলী হাট থেকে ইফাত যে গরুটি কিনেছেন তার দাম ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা- এমন একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন ইফাত।

মতিউর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, এই চারজনই তার পরিবারের সদস্য। সেখানে ইফাত নামে কেউ নেই।

খোঁজ নেই ইফাতের, কানাডা চলে যাওয়ার গুঞ্জন

ঈদের পরদিন থেকে ইফাতের কোনও খোঁজ মিলছে না। তার ফোন বন্ধ রয়েছে। ইফাতের খোঁজে সম্প্রতি ধানমণ্ডির ৮ নম্বর রোডের বাসায় গেলে নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ঈদের পরদিন তিনি বাসা থেকে বের হন; আর ফেরেননি।

এরই মাঝে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাটে আছেন তিনি। তিনি দেশ ছেড়েছেন– এমন গুঞ্জনের খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

এদিকে গাড়ি সংক্রান্ত একটি ফেইসবুক পেইজে মুশফিকুর রহমানের ইফাতের নামে দেওয়া একটি পোস্টের স্ক্রিনশট পেয়েছে সকাল সন্ধ্যা।

ওই পোস্টে জানানো হয়েছে, তিনি তার চারটি গাড়ি- টয়োটা প্র্যাডো, প্রিমিও, ক্রাউন ও হোন্ডা সিভিক মাস খানেকের মধ্যে বিক্রি করতে চান। কারণ কানাডা চলে যাবেন। বিস্তারিত জানতে ইনবক্সও করতে বলা হয়েছে ওই পোস্টে।

ফেইসবুকের ওই অ্যাকাউন্ট আসলেই আলোচিত মুশফিকুর রহমানের ইফাতের কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ইফাতের সঙ্গে সম্পর্কের কথা মতিউর রহমান অস্বীকার করলেও সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী দাবি করেছেন, এই তরুণ এনবিআরের এই কর্মকর্তারই সন্তান।

নিজাম হাজারী

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী বৃহস্পতিবার সকাল সন্ধ্যাকে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, তারই মামাত বোনকে বিয়ে করেন মতিউর। তাদেরই সন্তান এই ইফাত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট (সদস্য, এনবিআর) দায়িত্বে রয়েছেন।

তার বক্তব্য অনুযায়ী, তার একমাত্র স্ত্রীর নাম লায়লা কানিজ লাকী। যিনি এবার নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী। এখন আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম হাজারীর কথায় তার আরেক স্ত্রীর সন্ধান মিলল, যদিও মতিউর এই সম্পর্কের কথা প্রকাশ করছেন না।

নিজাম হাজারীর এমন বক্তব্য আসার পর বৃহস্পতিবার মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালালেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকেও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু তিনি এবিষয়ক কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না বলে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত