বিমানবন্দরে শুল্ক কর্মকর্তাদের কাছে অবৈধ সোনার বারসহ হাতেনাতে আটক হয়েছিলেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জেড এ শরীফ। কিন্তু ফৌজদারি মামলা না করেই তিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
সোনা চোরাচালানে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার নজির থাকলেও তাকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
এদিকে অভিযোগের মুখে থাকা ডা. শরীফ ও যাত্রী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন দাবি করছেন, তারা ‘ষড়যন্ত্রের শিকার’।
গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে চারটি সোনার বারসহ ধরা পড়েন বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে ২০১২ সাল থেকে কর্মরত জেড এ শরীফ।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে আসা যাত্রী মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের কাছ থেকে সোনা নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাইরে পাচার করছিলেন। তার আগেই বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়েন ।
ডা. শরীফ যার কাছ থেকে সোনার বার নেন সেই যাত্রী আলাউদ্দিনকেও আটক করা হয়। গত সোমবার সকাল ১০টার দিকের এই ঘটনায় বিমানবন্দরজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
তবে কোনও মামলা না করেই রাতে ডা. শরীফ ও যাত্রী আলাউদ্দিন ছেড়ে দেন শুল্ক কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে এর আগে কাস্টমস, বিমানবন্দরে কর্মরত সিভিল এভিয়েশন, এয়ারলাইন্স কর্মী জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও সরকারি চিকিৎসক জড়িত থাকার ঘটনা এটাই প্রথম। তাই দিনভর সবার নজর ছিল বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ফৌজদারি মামলা না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়
বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন পাটোয়ারী সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত চিকিৎসককে স্বাস্থ্য বিভাগের তিনজন কর্মকর্তা উপপরিচালক ডা. ইফতেখার উদ্দিন, সহকারী পরিচালক ডা. সুমন বড়ুয়া ও বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাবেদের জিম্মায় সোমবারই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “তিন কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়েছেন অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিবেন। সেটি আমাদের জানাবেনও। আর তার কাছ থেকে উদ্ধার করা সোনার বারগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।”
ফৌজদারি অপরাধে মামলা না করে ‘মুচলেকা নিয়ে ছাড়ার’ কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার বদরুজ্জামান মুন্সি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিনি যেহেতু একজন বিসিএস কর্মকর্তা, তারওপর তার নিজ দপ্তরই তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা নিবেন বলে মুচলেকা দিয়েছেন। সেজন্য আমরা তাতে সায় দিয়েছি।
“চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী আমরা মামলা করলে উচ্চ আদালতে গিয়ে সেটি নাও টিকতে পারে, সেই বিষয়ও আমাদের আমলে নিতে হয়েছে।”
বিসিএস অফিসার হিসেবে জেড এ শরীফ কি ‘বিশেষ সুবিধা’ পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে বদরুজ্জামান বলেন, “ফেভার করা হয়নি। তবে বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
সোনার বারসহ বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আটক
সোনা সরবরাহকারী যাত্রী আলাউদ্দিনকে কেন ছেড়ে দেওয়া হলো- তার উত্তরে ব্যারিস্টার মুন্সি বলেন, “হাতেনাতে তার কাছ থেকে তো স্বর্ণ পাওয়া যায়নি। এরপর মামলা করলে তাকেও আসামি করা হবে।”
আইন-বিধিতে যা আছে
কাস্টমস আইন ২০২৩ ও ব্যাগেজ রুলস বিধিমালা-২০২৩ এর কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই কত গ্রাম আনলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার গত সোমবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আটক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫শ গ্রামের বেশি অবৈধ সোনার বার না থাকায় ফৌজদারি মামলা করা হয়নি। তার কাছে চারটি সোনার বার পাওয়া গেছে, যেগুলোর ওজন ৪৬৪ গ্রাম।
ব্যাগেজ রুলসে বলা আছে, একজন যাত্রী কেবল একটি সোনার বার (১১৬ গ্রাম) শুল্ক পরিশোধ করেই ছাড় নিতে পারবেন। এর বেশি সোনার বার আনলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হবে রাষ্ট্রের অনুকূলে। আর বিদেশ থেকে আসা একজন যাত্রীকে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম বা ১ ভরি সোনা আনার জন্য শুল্ক দিতে হবে ৪ হাজার টাকা।
সোমবারের ঘটনায় আইন লঙ্ঘন হয়েছে কি না- সে বিষয়ে জানতে বিমানবন্দরে আগে কাজ করেছেন, চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “আসলে আইনে বা বিধিতে কোথাও বলা নেই যে কত গ্রাম আনলে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। এটি সম্পূর্ণ কাস্টমস কমিশনারের এখতিয়ার।
“আর এটা মুলত প্রাকটিস, যেটি আমরা স্যারের নির্দেশনা হিসেবে মেনে চলি। আর অভিযুক্ত ব্যক্তির অবস্থান বুঝেই কাস্টমস কমিশনার হয়তো মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
এ বিষয়ে জানতে কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমানকে ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
আইনের লঙ্ঘন বলছেন আইনজীবীরা
হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়ায় আইনের বড় লঙ্ঘন হয়েছে বলে বলছেন আইনজীবীরা।
চট্টগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেই ডাক্তারকে হাতেনাতে আটকের পর তাকে ফৌজদারি মামলা না দেওয়া একটি গর্হিত কাজ, আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিভাগীয় মামলা তো তার সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগ করবে। এর আগে ফৌজদারি মামলা হতে হবে। এটি এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই।”
মামলা না করার পেছনে সংশ্লিষ্ট সংস্থার অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল বলেই কাস্টমস তাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে সন্দেহ আখতার কবিরের।
তিনি বলেন, “এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? আর ডাক্তার বা বিসিএস ক্যাডার বলে তার প্রিভিলেজ পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ডাক্তারের মহান পেশায় থেকে চোরাচালানে সম্পৃক্ত হওয়া কলঙ্কের।”
চট্টগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি আখতার কবির মনে করেন, ডাক্তারদের দিয়ে সোনা চোরাচালানের তদন্ত করে বাস্তব সত্য কতটা উঠে আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এজন্য ফৌজদারি মামলা করা হলে পুলিশই বিষয়টি তদন্ত করে সত্য উদঘাটনে আরও বেশি চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু তা করা হয়নি।
আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ফৌজদারি মামলা করে তদন্তের দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হোক। তা না হলে ডাক্তারও চোরাচালানে সম্পৃক্ত হবে- সাধারণে এমন ধারণা জন্মাবে।
কী ব্যবস্থা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ
ঘটনার দিন তিন কর্মকর্তা গিয়ে ডা. জেড এ শরীফকে ছাড়িয়ে আনার পর বিমানবন্দরে কর্মস্থল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। তার বিরুদ্ধে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. সুমন বড়ুয়া বুধবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তদন্ত চলছে। বিস্তারিত আমি বলতে পারব না। আপনি (প্রতিবেদক) উপ-পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদকে ফোন করে বিস্তারিত জেনে নিন।”
ঘটনার দিন মুচলেকা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন ডা. ইফতেখার আহমদ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সোমবারই আমরা ডা. জেড এ শরীফকে প্রত্যাহার করেছি। সেখানে আরেক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। একদিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় পাঁচ কর্মদিবস বাড়ানো হয়েছে। আর কাস্টমসের কাছ থেকে আলামত চেয়েছি। তারা যত দ্রুত দিবে ততই দ্রুত তদন্ত কাজ শেষ হবে।”
বিভাগীয় নাকি ফৌজদারি মামলা হবে জানতে চাইলে ডা. ইফতেখার আহমদ বলেন, “কোন মামলা করা হবে আমরা জানি না। তবে তদন্ত শেষ হলে আমরা প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠাবো। সেখানে আইন শাখা সেটি দেখবে।”
শরীফ বলছেন ফাঁসানো হয়েছে
ঘটনার পর ডা. শরীফকে বিমানবন্দর থেকে প্রত্যাহারের পর গতকাল বুধবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে সকাল সন্ধ্যার। তিনি ঘটনাটিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।
যুক্তি হিসেবে শরীফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এক সরকারি কর্মকর্তার সোনা পাচারের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। এই বিমানবন্দরে গত ১২ বছর ধরে তো আমি কাজ করেছি। কখনও তো অভিযোগ আসেনি। এর বেশি কিছু বলব না। তদন্ত চলছে।”
যাত্রী আলাউদ্দিনও বলছেন ষড়যন্ত্র
ডা. জেড এ শরীফকে কীভাবে সোনার বারগুলো দেন সে সম্পর্কে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন যাত্রী আলাউদ্দিন।
তিনি বলছেন, ডা. শরীফের কাছাকাছি তার বাড়ি। তবে তারা আত্মীয় নন। এক বছর আগে আলাউদ্দিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। মায়ের অসুস্থতার খবরে তিনি দেশে আসেন সেদিন।
আলাউদ্দিনের ভাষ্যমতে, উড়োজাহাজে এক অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি প্যাকেট নেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল বিমানবন্দর দিয়ে সেটি পাচার করে দেওয়া। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগে ডা. শরীফ কর্মরত আছেন- সেটা আগেই জানতেন।
সেই সুযোগ নিতে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার আগেই তিনি শরীফের কাছে গিয়ে পকেটে সেই প্যাকেট ঢুকিয়ে দেন। এই সময় চোখ পড়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তার। শরীফ যেমন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে খেয়াল করেননি, তেমনি আলাউদ্দিন তাকে চেনেন না। এই সুযোগে দৌড়ে এসে দুজনকেই হাতেনাতে ধরা ফেলেন কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এরপর স্ক্যানেও ডা. শরীফের পকেটে চারটি সোনার বার ধরা পড়ে।
আলাউদ্দিন বলছেন, ডা. শরীফকে যে সোনার বার তিনি দিবেন তা শরীফ জানতেন না। আচমকা পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়ায় তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। লোভে পড়ে এই কাজ করেন জানিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, “আমি চেয়েছিলাম এখন বারগুলো তাকে দিয়ে দিলে পরে এসে সেগুলো নিয়ে নিব।”
কারও চাপে পড়ে বা প্রলোভনে এখন উল্টো কথা বলছেন কিনা- জানতে চাইলে আলাউদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি আসলে বুঝিনি বিষয়টি এতটা বড় হবে। ৭০ হাজার টাকার টিকেটের টাকা তুলতেই আমি এই রিস্ক নিয়েছি।”
আলাউদ্দিন ঘটনাটিকে ষড়যন্ত্র বলতে চান। এমন অভিযোগের ভিত্তি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিমানবন্দরে আটকের পর উপস্থিত কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা দলের একাধিক কর্মকর্তার কথোপকথনে সেটি মনে হয়েছে। এই বক্তব্য আমি স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত কমিটিকে লিখিতভাবে দিয়েছি।”
বিমানের মধ্যে সোনার বার দেওয়া সেই ব্যক্তিটি কে- জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বলেন, তিনি তাকে চিনেন না। তার নাম আবদুল্লাহ। বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া। আর এয়ার এরাবিয়ার বিমানেই তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
আলাউদ্দিন বলেন, “ঘটনার পর ছাড়া পেয়ে সেই লোকের কাছে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটি ছিল দুবাইয়ের নাম্বার। কিন্তু সে তো দেশে। ফলে যোগাযোগ আর হয়নি।”