Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

সোনা পাচার করেন যারা, কীভাবে করেন

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।
[publishpress_authors_box]

কলকাতায় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের পর সোনা চোরাচালানের বিষয়টি আবার উঠেছে আলোচনায়। আকাশ পথে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা সোনা মূলত স্থল সীমান্ত দিয়ে যায় ভারতে।

কীভাবে তা যায়, কারা তা নেয়, ছয় মাস লেগে থাকার পর এক পাচারকারী মুখ খুললেন সকাল সন্ধ্যার কাছে; জানালেন, জীবনের ঝুঁকি, গ্রেপ্তারের আতঙ্ক নিয়ে কীভাবে এই চক্রের অংশ হয়ে থেকেছেন তিনি।

দীর্ঘ আলাপে বিস্তারিত জানালেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি ওই ব্যক্তি। তার ছদ্ম নাম ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। ধরা যাক, তার নাম মারুফ হাওলাদার। তিনি দাবি করেছেন, এক সময় এই চক্রে থেকে কয়েকশ চালান সোনা পার করেছেন তিনি। তবে এখন সে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

যে চক্রে মারুফ জড়িত ছিলেন, তাতে ৩০ থেকে ৩৫ জন সদস্য থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। ঢাকার রেল স্টেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থল সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে সোনা পৌঁছে দেওয়াই তাদের কাজ।

নিজের কথার সত্যতা প্রমাণে পাসপোর্ট দেখান মারুফ; যেখানে তার অসংখ্যবার ভারতে যাতায়াতের তথ্য রয়েছে।

“আমি নিজেই তো এই চক্রের সদস্য ছিলাম। যে নিউজ দিয়েছি, এটা একশতে দেড়শ পারসেন্ট শিয়র। সবার পাসপোর্ট দেখলেই প্রমাণ পাবেন,” জোর গলায় বলেন তিনি।

পাচার যে প্রক্রিয়ায়

মারুফ জানান, সোনা পাচারের সময় দুই দলে ভাগ হয়ে ভারত যান তারা। একদল সোনা নিয়ে যান, আরেক দল যান খালি হাতে।

তিনি বলেন, “টোটাল কথা হলো, যেদিন বাংলা ট্রেন (কলকাতাগামী ট্রেন) যায়। মানে সপ্তাহে দুই দিন বাংলা ট্রেন যাবে। সেই দিন চক্রের চার থেকে পাঁচজন যাবে। কেউ ৮টি, কেউ ১০টি ও কেউ ১২টি করে সোনার বার নিয়ে যায়।”

মূলত ট্রেনেই সবচেয়ে বেশি সোনা পাচার হয় বলে মারুফের দাবি।

“ইমিগ্রেশন আগেই করিয়ে দেয়। ওখানে এই চক্রের দালাল আছে, ওরা খুব দ্রুত করে দেয়। দালাল চক্রের সদস্যদের পার পাসপোর্ট ৫০০ করে দিতে হয়।”

রেলের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশেও সোনা পাচার হয় বলে দাবি করেন মারুফ। আগে পায়ুপথে চক্রের সদস্যরাই সোনার বার বহন করতেন। তবে কয়েকটি চালান ধরা পরার পর কৌশল পরিবর্তন করে রেলের কর্মীদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

“ট্রেনের কিছু কর্মচারী, সোনার বারগুলো তারা নিয়ে ট্রেনের ভেতরে বিশেষ গোপন স্থানে রেখে দেয়। তারা কোথায় রাখে, তারা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। আবার ট্রেন থেকে নামার আগে সেগুলো আবার দিয়ে যায়।”

ভারতের ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশন থেকে ছাড়লেও ট্রেন পরিচ্ছন্ন করার জন্য যখন কমলাপুরে লোকো শেডে নেওয়া হয়, তখনই সোনার বারগুলো লুকিয়ে রাখা হয়।

কমলাপুরে সোনা নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা ব্যক্তিরা রয়েছেন বলে জানান মারুফ।

একসঙ্গে ভ্রমণ, অথচ কেউ কাউকে চেনে না

মারুফ জানান, পাচারের সময় চক্রের বেশ কয়েকজন একসঙ্গে গেলেও কেউ কাউকে চেনেন না। আবার প্রতি চালানে পরিবর্তন হতো দল।

চক্রের কেউ ধরা পড়লে কী হয়- প্রশ্নে তিনি বলেন, “কেউ ধরা পড়লে প্রথমে আমাদের মানে (চক্রের অন্য সদস্যের) সবার মোবাইল বন্ধ করে সবাই পালিয়ে যাই। ধরা খাওয়ার পর দুই মাস কোনও হদিস থাকে না কারও।”

সোনা পাচার করে ফিরে আসার পর ঢাকার আস্তানায় যান চক্রের সদস্যরা। ঢাকার মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনে এমন একটি আস্তানার খবর দেন মারুফ।

তিনি বলেন, “সেখানে ভাগাভাগি হয় কোথায় কাকে কত টাকা দিতে হবে। সেখানে বসেই ঠিক করা হয়।”

তিন তলা ওই ভবনের দোতলার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন এই চোরাকারবারে বিনিয়োগকারী এক কাপড়ের ব্যবসায়ী।

মারুফের ভাষ্য অনুযায়ী, ফ্ল্যাটটি বেশিরভাগ সময় তালাবদ্ধ থাকে। যিনি ভাড়া নিয়েছেন, তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন কাছেই আরেকটি ভবনে।

ভারত সীমান্তে এমন সোনার বার ধরা পড়ে প্রায়ই।

ওই কাপড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আরও দুজন ব্যবসায়ী এতে জড়িত বলে দাবি করেন মারুফ। তিনি বলেন, এদের একজনের কাপড়ের দোকান রয়েছে ঢাকার একটি বড় বিপণি বিতানে। অন্য দুজনের একজন ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করেন, আরেকজনের মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা রয়েছে।

মারুফ বলেন, “ওই বাসা থেকে সোনার বার নিয়ে সবাই বের হয়। আবার ওই বাসাতে সবাই যায়। সবাই ভেতরে গেলে বাইরে থেকে একজন দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর রুমের ভেতরে টাকা বের করে। টাকা গুনে বান্ডেল করে। পরে মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা যিনি করেন, উনার ওখান থেকে লোক আসে। এসে স্কুল ব্যাগে করে নিয়ে যায়।”

ওই তিন ব্যবসায়ীর পেছনে কারা আছে, সে খবর জানান সুযোগ ঘটেনি মারুফের। সোনা কোত্থেকে আসে, তাও অজানা থাকে মারুফদের কাছে। তারা শুধু পরিবহনের কাজটি করেন।

মারুফ এই চক্রে ৩০-৩৫ জন থাকার কথা জানালেও চিনতেন কেবল ৪-৫ জনকে। কে কোথায় থাকে, সেটাও জানতেন না।

প্রতি মাসে ৪-৫ বার ভারতে যেতে হতো মারুফের।

তিনি বলেন, “কোনও কোনও সময় যেতে হয়েছে সপ্তাহে ৩-৪ দিন। যখন চাপ থাকত বেশি।”

কলকাতায় ‘নিরাপদ’ এলাকা

কলকাতার কয়েকটি এলাকার হোটেলকে নিরাপদ ভাবেন সোনা চোরাচালানিরা। তার মধ্যে রয়েছে- নিউ সিটি হোটেল, গোল্ডেন অ্যাপেল, আফরিদি ইন্টারন্যাশনাল, গোল্ডেন অ্যাপেল বিউটি কুইন।

মারুফের ভাষ্যে, “যত পাচারকারী, সবাই এসব হোটেলে উঠে। এখানে উঠার পর সব পার্টি আসে। হোটেলে বসেই কথা-বার্তা ফাইনাল হয়। এরপর দোকানে গিয়ে সোনার বার দিয়ে আসতে হয়।”

চক্রের সদস্যরা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে সোনার বারগুলো নিয়ে চলে যায় নির্দিষ্ট সোনার দোকানে। বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসে হোটেলে।

“সেখানে গুছিয়ে বান্ডেল করে আমরা নিয়ে আসতাম,” বলেন মারুফ।

তিনি বলেন, “আগে সবাই মিলে হোটেলে সব বার একসাথে করে নিয়ে যেতাম। কিন্তু এক বার প্রায় ৬৫টি বার একজন নিয়ে যাওয়ার সময় ‘কট’ দিয়ে নিয়ে যায় ভারতের একটি চক্র। এরপর থেকে আলাদা সিস্টেম করা হয়েছে। যেন একটি চালান ধরা পড়লেও তেমন সমস্যা না হয়।”

ছয় মাস আগের একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে মারুফ বলেন, “হোটেল থেকে বের হয়েছি চারজন। আমাদের চারজনের কাছে সব মিলিয়ে না হলেও ৩ কোটি টাকা ক্যাশ আছে। একদম ক্যাশ। আমি সব সময় ওদের আগে পাঠিয়ে দিয়ে ১০ মিনিট পরে বের হই। ট্যাক্সি ডাক দিয়েছে, উঠবে, সেই মূহূর্তে কেউ না কেউ আগে থেকেই ইনফর্মেশন দিয়ে দিয়েছে। আস্তে করে ট্যাক্সির সামনে এসে সাদা জিপ গাড়ি এসে দাঁড়ায়। পুলিশ পরিচয় দিয়ে টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়।”

সীমান্তে বিজিবি প্রায় সোনার চালান আটক করে।

কত লাভ হয়

এই সোনা চোরাচালানে বিপুল পরিমাণ লাভ বলে জানান মারুফ।

তিনি বলেন, “কেউ যদি ছয় মাস ধরা না পড়ে, তাহলে কত কোটি টাকা যে লাভ হয়, সেটা কল্পনার বাইরে। ছয় মাসের মধ্যে তিন চালান ধরা পড়লেও সমস্যা নেই। মানে হলো আপনার ধরেন যে আপনার মাথার চুল থেকে যদি ২০টি চুল পড়ে যায়, আপনার কিছু কি হবে? ঠিক তেমনই।”

যেভাবে এই চক্রে

অভাবের সংসার মারুফের। ঢাকার বাড্ডায় তার ফুপাত ভাইয়ের দোকানের জন্য চকলেট ও বিভিন্ন খাদ্য পণ্য ভারত থেকে আনা-নেওয়া করতেন তিনি। সেই মালামাল ঢাকার বিভিন্ন দোকানে দিতেন।

মারুফ চোরাকারবারে বিনিয়োগকারী হিসাবে যে তিন ব্যবসায়ীর কথা বলেছেন, তার ওই ফুপাত ভাই তাদেরই একজন।

“একদিন ভাই বলল, ‘অনেক টাকা কামাইতে পারবি, সোনার বার ভারতে নিয়ে যাবি, কোনও সমস্যা হবে না। এর জন্য প্রতি ট্রিপে পাবি ২০-৩০ হাজার টাকা।”

অর্থের লোভে এই চক্রে জড়িয়ে পড়লেও তার টাকা ফুপাত ভাইর হাতেই যেত বলে জানান মারুফ। টাকার অঙ্কে তা ২০-৩০ লাখ টাকা বলে দাবি করেন তিনি।

মারুফ বলেন, “গাধার মতো খেটেছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ২৪ ঘণ্টা থাকতে হত গ্রেপ্তারের আতঙ্কে। আপনি বোঝেন, এক রাতেই ঢাকা টু ভারত যাওয়া-আসা! এর মধ্যে কোনও রেস্ট নেই। তবুও আজ নিজের টাকা চাইতে গেলে জীবনের ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে।”

কেন ছাড়লেন

চোরাকারবার থেকে বেরিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে মারুফ বলেন, উৎকণ্ঠাময়, অনিশ্চিত জীবনের ভার আর বহন করতে পারছিলেন না তিনি।

“এইটার মধ্যে যে কী টেনশন ভাই! কোটি টাকা কামাইয়াও ১ ঘণ্টা শান্তিতে থাকা যায় না। অলটাইম এই প্যারাটা মাথার ওপর নিয়ে চলতে হয়। এর থেকে আর বড় কোনও প্যারা আছে ভাই বলেন? সেখানে আমি টানা এক বছর চোর-পুলিশ খেলেছি।”

নিজের পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ প্রকাশের সময় তিনি বলেন, “আমি এই পথ থেকে সরে এসে ভালো আছি। তবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি সব সময়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত