মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে তিন দফায় সোনার দাম সাড়ে ৫ হাজার টাকা বাড়িয়েছিল দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। কারণ দেখিয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারকে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ডামাডোলে বিশ্ববাজারে যখন সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী, তখন আবার বাজুস দিয়েছে দাম কমিয়ে। এবার কারণ দেখিয়েছে স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার দাম কমে যাওয়াকে।
বিশ্বে যে কোনও অনিশ্চয়তা দেখা দিলেই সোনার দাম চড়তে থাকে। বিশ্ববাজারের প্রভাব তখন স্থানীয় বাজারেও পড়ে।
কোভিড মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে সোনার দাম বাড়লেও পরে স্থিতিশীল হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার হ্রাস করবে, বাজারে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়তে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতায় মূল্যবান এই ধাতুর দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে প্রতি আউন্সের দাম ছিল ২ হাজার ডলারের নিচে। তারপর থেকে আর কমেনি।
শনিবার বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ছিল ২ হাজার ৩৯০ ডলার ৮৬ সেন্ট। এক দিনে প্রতি আউন্সের দাম বাড়ে ১০ ডলার ৮১ সেন্ট বা শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার দেশের বাজারে যখন সোনার দাম বাড়ানো হয়েছিল, তখন বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্সের দাম ছিল ২ হাজার ৩৭৯ ডলার ৩১ সেন্ট।
অনিশ্চিত বিশ্বে সোনায় বিনিয়োগ বাড়ায় এর দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ডলারে পৌঁছতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক সিটি এনএ’র এক প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে।
তার মধ্যেই শনিবার বিকালে সোনার দাম কমানোর ঘোষণা দিয়ে বাজুস জানায়, নতুন দর সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হবে।
বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমানের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাম কমানোর ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) দাম হ্রাস পেয়েছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন দর অনুযায়ী, হলমার্ক করা প্রতি ভরি ভালো মানের ২২ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৮ টাকায় বিক্রি হবে। ২১ ক্যারেটের সোনার দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৯৮ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৯৭ হাজার ১৯৬ টাকা।
আর সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরি সোনা বিক্রি হবে ৭৮ হাজার ২৪২ টাকায়।
এই দফায় দাম কমানোর আগে হলমার্ক করা প্রতিভরি ২২ ক্যারেটের সোনা ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকায়, ২১ ক্যারেট ১ লাখ ১৪ হাজার ২০২ টাকায় এবং ১৮ ক্যারেট ৯৭ হাজার ৮৮৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরি ছিল ৭৮ হাজার ৮০২ টাকা।
হিসাব করে দেখা যায়, প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম কমেছে ৮৪০ টাকা। ২১ ক্যারেটের দাম কমেছে ৮০৫ টাকা। ১৮ ক্যারেটের কমেছে ৬৮৮ টাকা। সনাতন পদ্ধতিতে কমেছে ভরিতে ৫৬০ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে রোজার ঈদের আগে দুই দিনের ব্যবধানে সবচেয়ে ভালো মানের সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ৫০০ টাকা বাড়ানো হেয়ছিল।
গত ৬ এপ্রিল বাড়ানো হয় ভরিতে ১ হাজার ৭৫০ টাকা। দুদিন বাদে ৮ এপ্রিলও বাড়ানো হয় ১ হাজার ৭৫০ টাকা।
ঈদের পর গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) আবার বাড়ানো হয়েছিল দাম। সেই দফায় বাড়ানো হয় ভরিতে ২ হাজার ৬৫ টাকা। তাতে ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরি ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকায় উঠেছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড দর।
সব মিলিয়ে ১২ দিনের ব্যবধানে তিন দফায় সবচেয়ে ভালো মানের সোনার দাম ভরিতে সাড়ে ৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িয়েছিল বাজুস। সেখানে শনিবার কমানো হল ৮৪০ টাকা।
সোনার দাম এত কম সময়ে বাড়ছে-কমছে কেন- প্রশ্নের উত্তরে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সোনার দাম নির্ধারণের পদ্ধতি তারা বদলেছেন, এখন তারা বিশ্ব স্বীকৃত ‘ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল পলিসি’ অনুসরণ করেন।
সেই পদ্ধতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এতদিন আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে গোল্ডের দাম নির্ধারণ করতাম। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে যখন স্বর্ণের দাম কমত, তখন আমরা কমাতাম। আর যখন বাড়ত, তখন বাড়াতাম।
“এখন আমরা আমাদের স্বর্ণের সবচেয়ে বড় বাজার তাঁতীবাজারের বুলিয়ান মার্কেট ফলো করে দর নির্ধারণ করি। এই বাজারে স্বর্ণের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠা-নামা করে। সেটা অনুসরণ করে আমরা নতুন দর নির্ধারণ করি। সেক্ষেত্রে এমনও হতে পারে, দিনে দুই বারও গোল্ডের দাম বাড়ানো-কমানো হতে পারে।”
কেন পদ্ধতি অনুসরণ করছেন- জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান বলেন, সোনা আমদানি না হওয়ার কারণেই দেশের বাজারকে মানদণ্ড ধরছেন তারা।
“আমরা এখন বৈধভাবে কোনও গোল্ড আমদানি করি না। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে গোল্ড আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। প্রথম দিকে কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি করলেও এখন কেউ করছে না। কেননা, ডিউটি (শুল্ক) অনেক বেশি। আমদানি করলে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে।”
সেই কারণে বাজুস সভাপতি, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের নির্দেশনায় ‘ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের পলিসি’ অনুসরণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশে গোল্ড রিফাইনারি শুরু হলে এবং শুল্ক কমালে বৈধভাবে আমদানি হলে, তখন আমরা আবার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে গোল্ডোর দাম নির্ধারণ করব।”