বিদ্রোহীদের একটি নতুন জোটের আকস্মিক হামলার ঘটনায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আবারও বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। বুধবার বিদ্রোহী জোটের আকস্মিক হামলায় সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো থেকে পিছু হটে সরকারি বাহিনী।
২০১৬ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে আলেপ্পো থেকে পিছু হটা বিদ্রোহীরা দীর্ঘ আট বছর পর আলেপ্পোতে ঢুকতে পারল।
এতে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর লড়াই অনেকটা স্তিমিত থাকলেও বিদ্রোহীদের নতুন হামলা ঘিরে তা পুনরুজ্জীবিত হলো বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, এক যুগের বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধে ৩ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ৬০ লাখের বেশি মানুষ। আর এর প্রভাব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পড়েছে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরু যেভাবে
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সিরিয়ার গণতন্ত্রপন্থী জনতা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ দাবিতে রাস্তায় নামে। তবে সরকারি বাহিনীর তীব্র বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের।
সরকারের কঠোর দমনপীড়নের মুখে সামরিক বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু সদস্য এবং ছোট ছোট মিলিশিয়াদের সমন্বয়ে সিরিয়ায় একটি সশস্ত্র বিরোধী দল গড়ে ওঠে।
বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত হলেও তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আসাদ সরকারকে উৎখাত করা। তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো সে সময় বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়।
সরকার বিরোধীদের শক্তি বাড়তে থাকলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে তার মিত্র দেশ ইরান ও রাশিয়া। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি ইরানের বিপ্লবী গার্ড ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ আসাদ সরকারের হয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে। আর সিরিয়ার বিমান বাহিনীর শক্তি বাড়াতে যুদ্ধবিমান নিয়ে এগিয়ে আসে রাশিয়া।
এমন পরিস্থিতিতে আল-কায়দাসহ চরমপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীগুলোও এই যুদ্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠে, যদিও সিরিয়ার মধ্যপন্থী বিদ্রোহীরা তাদের কখনোই স্বাগত জানায়নি। ২০১৪ সালে চরমপন্থীরা শক্তি বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠা করে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং সিরিয়া ও ইরাকের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।
এতে সিরিয়া জঙ্গিদের একটি বড় ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে– এমন আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক একটি জোট সিরিয়ায় আইএস দমনে নামে। তবে সে সময় তারা সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বাহিনীর সঙ্গে সেভাবে যুদ্ধে জড়ায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) আইএসের বিরুদ্ধে জোর লড়াই চালায় এবং তাদের দখল করা ভূমি থেকে উৎখাত করে।
অন্যদিকে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীও বিদ্রোহীদের হটিয়ে ইদলিব প্রদেশ বাদে সিরিয়ার বাকি অংশের অনেকটাই আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে রাশিয়া ও তুরস্ক ইদলিবে যুদ্ধবিরতি এবং যৌথ টহলের মাধ্যমে একটি নিরাপত্তা করিডোর প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়।
এরপর থেকে সিরিয়ায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের বড় ধরনের কোনও সংঘাতে খবর মেলেনি, তবে সরকারি বাহিনী এখন পর্যন্ত সিরিয়ার পুরো ভূখণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি।
আর বিদ্রোহীরা যেহেতু এখন সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল নিয়েছে, তার মানে, সেখানে সশস্ত্র প্রতিরোধ কখনোই শেষ হয়ে যায়নি।
আবার কেন সংঘাত
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ‘মিলিটারি অপারেশন্স কমান্ড’ নামে নতুন একটি জোট গড়ে তোলার পর বুধবার থেকে আলেপ্পোতে হামলা শুরু করে।
তারা দ্রুত আলেপ্পোর আশেপাশের গ্রামগুলো দখলে নেওয়ার পাশাপাশি শহরের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর এক্ষেত্রে তারা খুব সামান্য বাধার মুখে পড়েছে বলে দাবি করে।
সরকারি বাহিনীর সহায়তা রাশিয়া বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালালেও তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।
রবিবার বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, বিদ্রোহীদের হামলার মুখে টিকতে না পেরে সরকারি বাহিনী আলেপ্পো থেকে পিছু হটেছে। অর্থাৎ পুরো আলেপ্পোই চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে।
বিদ্রোহীরা বলছে, তারা দখলে থাকা সিরিয়ার ভূখণ্ড মুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি ইরান সমর্থিত যোদ্ধাদের আক্রমণের জবাব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ার আসাদ সরকারের অন্যতম প্রধান মিত্র রাশিয়াকে এখন ইউক্রন যুদ্ধ নিয়েই বেশি ভাবতে হচ্ছে, যার কারণে সিরিয়ায় তারা সেভাবে দৃষ্টি দিতে পারছে না।
আরেক মিত্র ইরানকে এখন ইসরায়েল এবং এই অঞ্চলে তাদের মিত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের লড়াইয়ের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। ফলে রাশিয়ার মতো তারাও সিরিয়ায় সেভাবে মনোযোগ দিতে পারছে না।
আর সিরিয়ার প্রধান দুই মিত্র শক্তির মনোযোগ অন্যত্র থাকার সুযোগটিই এখন বিদ্রোহীরা নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আলেপ্পো হারানো আসাদ বাহিনীর জন্য নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা। প্রাচীন এই শহরটি একসময় ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এবং দেশটির অর্থনৈতিক রাজধানী। ২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের সেখান থেকে হটিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আলেপ্পো ছিল বিদ্রোহীদের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্রোহীরা পুনরায় আলেপ্পো দখলে নেওয়ায় এখন তাদের আর শুধু ইদলিবেই আটকে থাকতে হবে না। একইসঙ্গে আলেপ্পোর পথ ধরে সিরিয়ার আরও এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের নেওয়ার সুযোগ এসেছে বিদ্রোহীদের সামনে।
সিরিয়ায় কারা বিদ্রোহী
সরকারবিরোধীদের নিয়ে গড়া সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নতুন জোটে ইসলামপন্থী থেকে শুরু করে মধ্যপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য রয়েছে।
এই জোটের নেতৃত্বে রয়েছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি আগে এক সময়ে আল-নুসরা ফ্রন্ট নামে সিরিয়ায় আল-কায়দার সহযোগী হিসেবে কার্যক্রম চালাত।
সিএনএন বলছে, ২০১৬ সালে সংগঠনটির নেতা আবু মোহাম্মদ আল জুলানির নেতৃত্বে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। পরে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে কার্যত তাদেরই শাসন চলছে এখন। তুরস্ক সমর্থিত একটি গ্রুপ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এছাড়া আগে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়া কিছু গোষ্ঠীও এইটিএসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এক সময় আইএসের সঙ্গে লড়তে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এসডিএফও নতুন এই জোটের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে জায়গা করে নিয়েছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
এসডিএফের মূল শক্তি হিসেবে পরিচিত কুর্দি যোদ্ধারা এর আগে ‘পিপলস প্রটেকশন ইউনিট’ (ওয়াইপিজি) নামে একটি সংগঠনের সদস্য ছিল। সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্ক এই ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে বিবেচনা করে। ফলে নতুন জোটে এসডিএফের সম্পৃক্ততাকে তুরস্কের ভালো চোখে দেখার কথা নয়।