আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নামে-বেনামে কী পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে আত্মসাৎ করেছেন তার হিসাব করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। লোপাট হওয়া এই অর্থের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি বলে ধারণার কথাও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে, “কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণের অর্থ আত্মসাত করেছেন এবং তা বিদেশে পাচার করেছেন, যার সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলমান রয়েছে। এই আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ লক্ষাধিক কোটি টাকার উপরে বলে ধারণা করা যায়।”
যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে ধারণা দেওয়া হচ্ছে তা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আট ভাগের এক ভাগের সমান। এই অর্থ দিয়ে দুটির বেশি পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব।
রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট খরচ হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে লোপাট হওয়া অর্থ দিয়ে রূপপুরের মতো আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও তৈরি করা সম্ভব।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালীরা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও, তাদের কারও নাম বিজ্ঞপ্তিতে জানায়নি সরকার।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেদিনই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরপর ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়, বদল আসে বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে। কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, কাউকে বাধ্য করা হয়, কারও জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয় নতুন কাউকে।
পরিবর্তনের ঢেউ লাগে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। বিতর্কিত পরিচালনা পর্ষদগুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় পুরোনো পরিচালকদের, কোথাও কোথাও নিয়োগ দেওয়া হয় স্বতন্ত্র পরিচালক।
এস আলমসহ বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠে অর্থ আত্মসাৎ-পাচারসহ নানা অভিযোগ। বেসরকারি যে ব্যাংকগুলোয় এস আলমের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেগুলোও আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করে সরকার।
এমন বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় এরই মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংকের পর্ষদগুলোও পুনর্গঠন করা হয়েছে।
“অবশিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে। নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা এসব অর্থের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তাদের মাধ্যমেই আত্মসাৎ করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের লক্ষ্যে অডিট কার্যক্রম শুরু করা হবে।”
অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচারের বিষয়ে সরকারের মনোভাব কঠোর জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, “ব্যাংকগুলোর নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, বিএফআইউই, সিআইডি ও দুদকের সহায়তা নিয়ে আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ ও বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে আত্মসাৎ হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে এরই মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে সরকার “
সরকার শিগগিরই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করবে এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি ব্যাংকে তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের জন্য ছয়মাসের মধ্যে একটি বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ তৈরি করার কথাও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের লক্ষ্য হলো আর্ন্তজাতিক মানদণ্ড পরিপালনে সক্ষম শক্তিশালী ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলা। তবে এই উদ্দেশ্যে সফল করতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়, আন্তর্জাতিক কারিগরি সহায়তা ও অর্থের প্রয়োজন হবে।
“বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার অর্থ আত্মসাৎকারীদের দেশি-বিদেশি সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশ থেকে ফেরত এনে ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে।”
ব্যাংকগুলোর এই পুনর্গঠন এবং আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার সময় সাপেক্ষ ব্যাপার জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলছে, সরকার বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার ব্যপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।