মিয়ানমারে বাংলাদেশঘেঁষা স্থানগুলোয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে সীমান্তের এপারেও। চলতি সপ্তাহেই মিয়ানমার থেকে উড়ে আসা গোলায় নিহত হয়েছেন এক বাংলাদেশি নারীসহ দুজন। গুলিতে আহত হওয়ারও খবর এসেছে।
ইতিহাস বলছে, যখনই বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমারে সংঘাত হয়েছে তখনই নেমেছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল। এবার এখনও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না ঘটলেও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও সেনা সদস্যসহ প্রায় ৪০০ মানুষ। এদের মধ্যে আহতদের বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হচ্ছে।
মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের জেরে বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটবে কি না, তা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা নানা শঙ্কার মধ্যেই বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মিয়ানমারে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
একই কথা বলেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। অবৈধভাবে একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
অবশ্য ২০১৭ সালেও শুরুতে এমন অবস্থান ছিল সরকারের। ভীষণ কঠোর থাকলেও পরে মানবিকতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের জন্য খুলে দেওয়া হয় সীমান্ত, আশ্রয় দেওয়া হয় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে।
সেই সময়ের পরিস্থিতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের গুণগত পার্থক্য আছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “২০১৭ সালে অনেক রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছিল। মোটাদাগে সেসময় আশ্রয় দেওয়াটি মানবিক বিষয় ছিল।”
এবার সরকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অবস্থান ধরে রাখতে হবে।
পারবে কি- প্রশ্নে অবসরপ্রাপ্ত এই কূটনীতিক বলেন, সরকার চাইলে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব।
তবে হুমায়ুন কবিরের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আমেনা মহসিন।
মিয়ানমারে বিরাট মানবিক বিপর্যয় ঘটলে তখনও কী বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ রেখে দিতে পারবে, প্রশ্ন তোলেন তিনি।
মিয়ানমারে এখনকার বাস্তবতায় বাংলাদেশকে আবার নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহিদুজ্জামান।
গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে একের পর এক মর্টারের গোলা ও গুলি এসে পড়ছে বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সীমান্তবর্তী এলাকার কয়েকশ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হচ্ছে।
রবিবার থেকে দফায় দফায় মিয়ানমারের বিজিপি, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইমিগ্রেশন সদস্য ও অন্যান্য সংস্থার কয়েক’শ সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছে বিজিবি। তাদের নিরস্ত্র করে নিরাপদ আশ্রয় ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বুধবার তমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শনে যান বিজিবি মহাপরিচালক।
সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ধৈর্য ধারণ করে, মানবিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
অন্যদিকে, মিয়ানমারের বিষয়ে এবার বাংলাদেশ আর উদার হবে না বলে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “এবার আর বাংলাদেশ উদারতা দেখাবে না। গতবার উদার হয়ে সীমান্ত খুলে দেওয়ায় (মিয়ানমারের) মানুষগুলো এসেছে। তখন যেরকম সহযোগিতা আমরা পেয়েছি, তা এখন পাচ্ছি না। যারা বাংলাদেশে এসেছেন তারা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে গেছেন। আর কয়দিন এই বোঝা সইব? ফলে, নতুন করে সীমান্ত খোলার কোনও সুযোগ নেই।”
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আর আগে বিভিন্ন সময়ে আরও প্রায় তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল।
সবমিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করা রোহিঙ্গা নাগরিকদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। যারা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছেন।
বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যূত্থানের পর পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
অধ্যাপক এম শহিদুজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ। আরাকান আর্মির কাছে ওদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। সীমান্ত অঞ্চলটাই মূল ফোকাস।”
এবারের সংঘাতের জের ধরে খুব বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ করবে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
তবে তিনি বলেন, “সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ নির্ভর করবে আমাদের নিরাপত্তা কতটুকু জোরদার তার ওপর। কিছুটা নির্ভর করবে আরাকান আর্মির কর্মকাণ্ডের ওপরও।”
মিয়ানমারের বাস্তবতা নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে কি না, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে ভাবতে হবে বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, “রাখাইনে আরাকান আর্মির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। আমাদের আঞ্চলিক সেনাবাহিনী ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা উচিৎ।”
অধ্যাপক আমেনা মহসিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যারা এবার আসছেন তারা সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী আশ্রয় দিতে হবে। পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না।”
এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চাপ আরও বাড়ানো উচিৎ বলে মত দেন তিনি।
মিয়ানমারে মানবিক বিপর্যয় ঘটলে তখন পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশকে সীমান্ত বন্ধ বা খোলা রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মত তার।
তিনি বলেন, “এখানে অনেকগুলো রাষ্ট্র জড়িত। চীনের ভূমিকা আছে। ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে জোর দাবি তুলতে হবে। জাতিসংঘ ইচ্ছা করলেও অবস্থান নিতে পারে।”
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার এখন সঠিক অবস্থানে আছে জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, “সরকারে সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত। তবে মিয়ানমারে যদি যুদ্ধ বাড়ে। রাখাইনের বৌদ্ধরা যদি পালিয়ে আসতে শুরু করে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
বিজিপির পালিয়ে আসা সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ায় দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি সেটা মনে করি না। ওখানে যুদ্ধাবস্থা চলছে এটা আমরা সবাই জানি। যারা আসছে তাদের একটা পরিচয় আছে। তবে না এলেই আমাদের জন্য ভালো।
“এখন কূটনৈতিক নিয়ম নীতি মেনে তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে।”