রোজায় বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পাওয়া যাচ্ছে না ২৯ পণ্যের ২৭টিই, অথচ এক্ষেত্রে নেই কোনও নজরদারি।
তবে ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দাম নির্ধারণের প্রভাব পড়েছে কোনও কোনও পণ্যে, বিক্রি হচ্ছে কাছাকাছি দামে।
বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের থেকেও কমে পাওয়া যাচ্ছে পণ্যটি। শুক্রবার রাজধানীর অধিকাংশ বাজারে পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
গত ১৫ মার্চ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যে ২৯ পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তার মধ্যে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৫ টাকা ৪০ পয়সা।
এছাড়া চাষের কাতলা মাছ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে। দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের কাতলা মাছ এই দরে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সরকার কাতলা মাছের যৌক্তিক খূচরামূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ৩৫৩ টাকা ৫৯ পয়সা।
অবশ্য, ২ কেজির বড় কাতলার দাম বাজার ভেদে ৩৫০ টাকা বা এর থেকে বেশি দরেও প্রতিকেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে। গুণগত মান ও আকারের ওপর ভিত্তি করে মাছের দাম বেশি বা কম হয়।
এই দুটি পণ্য ছাড়া বাকি ২৭টি পণ্যের দামই সরকার নির্ধারিত দামের থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
তবে কোনও কোনও পণ্যের দাম নির্ধারিত দামের কাছাকাছি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে টমেটো, মিষ্টি কুমড়া ও বেগুন। টমেটো পাওয়া যাচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। তবে আকারে বড় ও তরতাজা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। সরকার টমেটোর যোক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে ৪০ টাকা ২০ পয়সা।
ঢাকায় অধিকাংশ বাজারে মিষ্টি কুমড়া ফালি হিসেবে বিক্রি হয়। কেজি ওজনের এক ফালি মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা করে। তবে কোথাও কোথাও এর বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে। সরকার এক কেজি মিষ্টি কুমড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৩ টাকা ৩৮ পয়সা।
বাজারে অন্তত ৫ ধরনের বেগুন দেখা গেছে। এর মধ্যে একেবারে ছোট আকারের ও সবুজ রঙয়ের বেগুনগুলো ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বেগুনি রংয়ের লম্বা চিকন বেগুনগুলো ৫০ টাকা কেজি, বেগুনি রংয়ের মোটা বেগুন ৬০ টাকা কেজি। তাল বেগুন বলে পরিচিত বড় আকৃতির বেগুনের কেজি ৮০ টাকা।
তবে কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের তালিকায় আলাদা ধরনের বেগুনের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। সব ধরনের বেগুনের গড় দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সা।
তাছাড়া শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শীতকালীন সবজির সরবরাহ একেবারে কম। একই সময় বাজারে পটল, সজনেসহ নতুন নতুন তরিতরকারির সরবরাহ ভালো থাকায় শিম, বাঁধাকপি ও ফুলকপির কাটতি কমেছে। একারণে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে এসব সবজির দামের পার্থক্য নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যাথা নেই বলে জানান ঢাকার পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান।
পাঙ্গাস মাছ ও মাংসের দাম তালিকার থেকে অনেক বেশি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পাঙ্গাস বিক্রি করতে হবে কেজি ১৮০ টাকায়। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে। গরুর মাংস অধিকাংশ বাজারে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে। এই দুটি পণ্যের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে যথাক্রমে ৬৬৫ টাকা এবং ১ হাজার ৪ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৭৫ টাকা কেজি, বাজারে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালী মুরগির দাম সরকারের তালিকায় ২৬২ টাকা উল্লেখ থাকলেও বাজারে ৩০০ টাকা কেজি।
অন্য যেসব পণ্যের দামও বেশি
কাঁচামরিচ ৮০ টাকার নিচে কোথাও নেই। গাঢ় সবুজ রংয়ের কাঁচামরিচের ঝাল বেশি বলে বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা। এ ধরনের কাঁচামরিচের দাম ১০০ টাকা কেজি। অথচ সরকার কাঁচামরিচের খূচরামূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে কেজি ৬০ টাকা।
১০০ গ্রাম শুকনা মরিচের দাম ৫০-৬০ টাকা। কিন্তু সরকারের তালিকা অনুযায়ী দাম হয় ৩২-৩৫ টাকা।
আমদানিকৃত আঁদা কোনও বাজারেই ২০০ টাকার নিচে কেজি পাওয়া যায় না। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৮০ টাকা।
দেশি রসুন ১৬০ টাকার নিচে কেজি পাওয়া যায় না। সরকারের তালিকা অনুযায়ী দাম ১২০ টাকা।
আলুর খুচরামূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা। বাজারে আলুর সর্বনিম্ন দাম ৩৫ টাকা কেজি।
জাহিদী খেজুর পাওয়া কঠিন
শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর বাড্ডা লিংরোডের একটি ফলের দোকানে খেজুর কিনতে আসেন স্থানীয় ক্রেতা মো. ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, কোনও দোকানেই জাহিদী খেজুর নেই। সর্বনিম্ন দামের খেজুর আছে ৫০০ টাকা কেজি। এ খেজুরের নাম দাবাস খেজুর।
এই ক্রেতা বলেন, নিজ এলাকায় জাহিদী খেজুর না পেলে যেতে হবে কারওয়ান বাজার অথবা বাদামতলি। কিন্তু যাতায়ত খরচ যা হবে তা কোনোভাবেই পোষানো যাবে না। ফলে বেশি দামে দাবাস খেজুর কিনে ফিরছেন তিনি।
চিড়া বিক্রি হচ্ছে তালিকা থেকে ২০ টাকা বেশি দরে। বাজারে সাদা চিড়া ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সাগরকলা হালি ৪০ টাকার নিচে মেলে না কোথাও। কিন্তু সরকারের তালিকায় এর খুচরামূল্য ৩০ টাকা।
বেসনসহ সব ধরনের ডাল ও ছোলার দামও সরকার নির্ধারিত দামের থেকে বাজারে বেশি। মুগডাল ১৮০ টাকা, মসুর ডাল মিহি দানা ১৬০-১৭০ টাকা কেজি। মোটা দানার মসুর ডাল ১৩০ টাকা। ছোলা ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি।
মাসকালাই ও খেসাড়ির ডালের ব্যবহার হয় কম। সরকার নির্ধারিত খেসাড়ির ডালের দাম প্রতিকেজি ৯৩ টাকা। মাসকালাই ডাল প্রতিকেজি ১৬৭ টাকা। বাজার ভেদে দামে ১০-২০ টাকা পার্থক্য পাওয়া যায় এসব পণ্য।
ঢাকার গুলশানের মোড়ল কাঁচাবাজারে ডিম বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তারা সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করছেন না কেন? এর জবাবে মো. জাপানী নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, “১০ টাকা করে যে আমরা বিক্রি করি না তা নয়, যেগুলো ছোট ডিম সেগুলো ১০ টাকা পিচ বিক্রি করি।” তবে তিনি নিয়মিত আকারের ডিম ডজন বিক্রি করছেন ১৩৫ টাকা।
বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য পাওয়া না গেলেও বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা কিছুটা কমেছে।
আরিফুল ইসলাম নামের মোহাম্মদপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, লেবুর দাম কিন্তু সরকার নির্ধারণ করে দেয়নি। কিন্তু লেবু এখন ৩০ টাকা হালিতে নেমে এসেছে। কারণ বিক্রেতারা ভয় পেয়ে গেছেন। তারা আর দাম বাড়াতে ভয় পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য বছর রোজায় শসা, বেগুন এগুলোতে আগুন লেগেই থাকে। এবার কিন্তু এই ধরনের সবজিগুলোর দাম হাতের নাগালেই রয়েছে।
অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এভাবে মূল্য নির্ধারণ করে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। কোনও দেশেই এমন দাম নির্ধারণ (প্রাইসিং) করা হয় না। বাজার মূল্য স্বাভাবিক রাখতে হলে আমদানি অবারিত করতে হবে। কিছু পণ্য কেবল বড় বড় ব্যবসায়ীদেরকেই আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। একারণে বাজারে দাম তারাই নির্ধারণ করার সুযোগ পায়।
“আমদানি অবারিত করলে বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করা হবে। ফলে দাম স্বাভাবিক রাখতে হলে বাজারমুখী নীতি গ্রহণ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “টিসিবির (সরকারের বিপণন প্রতিষ্ঠান) মাধ্যমেও বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, কারণ তারাও বড় বড় গ্রুপের কাছ থেকে পণ্য কিনে বাজারে ছাড়ে। তারা নিজেরা আমদানি করলে দাম কমাতে পারতো। তারা কেবল ভর্তুকি দিয়ে দাম কমায়।”
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “ঘোষণা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”
সরকার যা করছে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে করছে উল্লেখ করে গোলাম রহমান বলেন, “সরকারের সদিচ্ছার কোনও ঘাটতি নেই। তবে এটা কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।”