Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

কোটা : আপিল বিভাগের রায়ের পর সরকারের প্রজ্ঞাপন

high court
[publishpress_authors_box]

সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দিয়েছে আপিল বিভাগ।

কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের মধ্যে রবিবার সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির দিনে আপিল বিভাগ শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেয়।

সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের রায় বাতিলের পাশাপাশি কোটার অনুপাত ঠিক করে দিয়ে তার আলোকে অতি দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।

তাতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে বরাদ্দ রাখতে বলা হয়েছে। বাকি ৭ শতাংশের মধ্যে বলা হয়েছে ৫ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য, ১ শতাংশ অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর জন্য এবং ১ শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য রাখতে।

তবে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই আদেশ দেওয়ার পর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন; সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছেন পাঠদানের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে।

রায়ের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার মঙ্গলবার আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার নতুন অনুপাত রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে। 

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে আগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। তারমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বরাদ্দ ছিল ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিয়োগের ক্ষেত্রে এই কোটা সুবিধা পেত। ১৯৯৬ সালে তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদেরও এই কোটার ‍সুবিধায় আনা হয়।

এছাড়া জেলা কোটায় ১০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০ শতাংশ, অনগ্রসর নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি কোটায় ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটায় ১ শতাংশ বরাদ্দ ছিল।

আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে এখন নারী ও জেলা কোটা বাদ পড়ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের চেয়ে ৮৩ শতাংশ কমে ৫ শতাংশে নেমে আসছে। সেই সঙ্গে আদালত শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা রাখতে বলেছে।

কোটার অনুপাত পুনর্বিন্যাস সরকারি চাকরিতে সব নিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছেন। তবে শুনানিতে অংশ নেওয়া আরেক আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেছেন, নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার এই অনুপাত কার্যকর হবে।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক পরে সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের রায়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনও গ্রেডের কথা বলা না হলেও সরকারি চাকরির সব গ্রেডের ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হবে।

নারী কোটা না থাকার বিষয়ে তিনি আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নারী কোটা বাদ দেওয়ার দাবি ওঠার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, আদালত হয়ত শিক্ষার্থীদের সেই দাবি বিবেচনায় নিয়েছে। 

আদালতে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন। যাদের রিট আবেদনে হাইকোর্টের রায় হয়েছিল, সেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে ছিলেন মনসুরুল হক চৌধুরী। হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হয়ে যে দুই শিক্ষার্থী এই মামলায় পক্ষভুক্ত হয়ে রায় স্থগিতের আবেদন করেছিলেন, তাদের পক্ষে ছিলেন শাহ মঞ্জুরুল হক।   

এছাড়া আদালতের আহ্বানে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, জয়নাল আবেদীন, জেড আই খান পান্না, আহসানুল করিম, ইউনুছ আলী আকন্দ, তানিয়া আমীর, সারা হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন।  

স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা কোটা ব্যবস্থা ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনের মুখে বাদ পড়ে। তখন সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা তুলে দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করেছিল।

সেই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে ২০২১ সালে হাইকোর্টে আবেদন করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। গত ৫ জুন হাইকোর্ট সেই মামলার রায়ে সব কোটা পুনর্বহাল করে। তবে রায়ে বলা হয়, সরকার চাইলে কোটার হার পুনর্বিন্যাস করতে পারবে।

সরকার ওই রায় স্থগিতে আবেদন করলেও এরই মধ্যে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে।

আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করলেও স্থিতাবস্থা জারি করে। সরকার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি নিয়ে আপিল আবেদন (লিভ টু আপিল) করার পর ৭ অগাস্ট শুনানির দিন ঠিক করে।

কিন্তু জুলাইয়ের প্রথমে রাজপথে আন্দোলন শুরুর পর ক্রমেই তা তীব্রতা পায়। গত ১৬ জুলাই এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সংঘাতে ছয়জন নিহত হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিক্ষার্থীদের আদালতের রায় অবধি অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলেও তাতে সাড়া মেলেনি।

১৮ জুলাই সহিংসতা আরও বেড়ে ৪১ জন নিহত হওয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের আলোচনায় আসার প্রস্তাব দেন।

তিনি তখন বলেছিলেন, “শুনানি এগিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছি। আগামী রবিবার তিনি আপিল বিভাগে আবেদন করবেন, যাতে মামলাটির শুনানির তারিখ তারা এগিয়ে আনেন।”

তিনি আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করে আরও বলেছিলেন, “উচ্চ আদালতে যখন এই মামলার শুনানি শুরু হবে, সরকার পক্ষ অবশ্যই একটা প্রস্তাব দেবে। এবং আমরা যেহেতু কোটা সংস্কারের পক্ষে, সংস্কারের পক্ষে প্রস্তাব দেব।”

বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী ওই কথা বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত শুনানির দিন এগিয়ে আনে।

এরমধ্যে সংঘাত আরও বেড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটলে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি রবি ও সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।

তবে এই ছুটির মধ্যেও রবিবার আপিল বিভাগে এই মামলার শুনানি হবে বলে আদালত প্রশাসন থেকে জানানো হয়।

কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আদালত বসার পর সকাল সোয়া ১০টায় শুনানি শুরু হয়ে কয়েক ঘণ্টা চলে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।

শুনানিতে সারা হোসেনের কথায় কারফিউর মধ্যে আদালত বসার বিষয়টি এলে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার বিভাগের ছুটি সরকার ঠিক করে না, প্রধান বিচারপতি ঠিক করেন। তবে সরকারের সঙ্গে মিল রেখে করা হয়। শনিবার যখন সরকার ছুটি ঘোষণা করেছিল, তখন প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রবিবার আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগেই কাজ চলবে। সেই সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কারফিউ জারি হয়। ফলে তার আগেই আদালত বসার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

এরপর সোয়া ১টার দিকে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এসময় প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই যখন স্থিতাবস্থা দিয়েছিল, তখন কিন্তু ২০১৮ সালের পরিপত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই আদেশের অর্থ শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি বলে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয়, অনেকের প্রাণ ঝরে যায়, যা মোটেও কাম্য ছিল না।

সরকার সংঘাত ও নিহতের ঘটনা তদন্তে বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে যে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন প্রত্যেকটি ছাত্রের মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে বলে প্রধান বিচারপতি আশা রেখেছেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীদের চিন্তায়, মননে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

আপিল বিভাগের রায়ের পর শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেবে বলে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আশা প্রকাশ করেন।

সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরাতে অভিভাবকদের সহায়তা চান প্রধান বিচারপতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে। 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত