এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনামলে ১৯৮৩ সালে একটি অধ্যাদেশ বলে গঠিত হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক; ২০১৩ সালে সেই অধ্যাদেশ আইনে পরিণত হলেও কর অব্যাহতি পাওয়ার ধারাটি থেকেই যায়।
সেই ধারাতেই আবার পাঁচ বছরের জন্য আয়কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো গ্রামীণ ব্যাংককে।
আইনটিতে চিরকালের জন্য কর অব্যাহতি দেওয়া হয়নি গ্রামীণ ব্যাংককে। এজন্য আবেদন করে তাদের এই সুবিধার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে।
তবে আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষ দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো হচ্ছিল না। তখন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টানাপড়েনও চলছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটার প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর তিন বছর বাদে আবার সেই সুযোগ পেল গ্রামীণ ব্যাংক।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গ্রামীণ ব্যাংককে আগামী ২০২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়কর অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সুবিধা পুনর্বহাল করা হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক আইনের ৩২ নম্বর ধারায় রয়েছে- “সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, Income-tax Ordinance, 1984 এর অধীন যে মেয়াদ নির্ধারণ করিবে, (গ্রামীণ) ব্যাংক সেই মেয়াদের জন্য উহার আয়ের উপর প্রদেয় আয়কর হইতে অব্যাহতি লাভ করিবে।”
ড. ইউনূসের উদ্যোগে সরকারের অংশীদারত্বে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক। ২০০৬ সালে এই কাজের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারও জয় করেন।
গ্রামীণ ব্যাংককে কেন আবেদন করতে হয়?
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর দিতে হয় না। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অধীনে তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আয়কর অব্যাহতি পায় আইনের বলেই।
কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক সেই তালিকায় নেই। এটি আলাদা আইনের দ্বারা গঠিত বলে সেই অব্যাহতির সুবিধা গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হয় না।
সেই কারণে মেয়াদ শেষে গ্রামীণ ব্যাংককে আবেদন করে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হয়। আবেদনে গ্রামীণ ব্যাংক বলে, যেহেতু সব মাইক্রোক্রেডিট অপারেশনের কর অব্যাহতি রয়েছে। সুতরাং তাদেরও একই রকম হওয়া উচিৎ।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের আইনে সকল মাইক্রোক্রেডিট অপারেশন করা সংস্থাগুলোকে কর অব্যহতি দেওয়া আছে। কিন্তু সেই আইনে গ্রামীণ ব্যাংক পড়ে না। কারণ ওখানে (আইনে) বলা আছে, মাইক্রোক্রেডিট নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে যারা নিবন্ধিত এনজিও, তাদের মাইক্রোক্রেডিট ওই কর অব্যাহতি পায়।”
“ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী সকল প্রতিষ্ঠান যেহেতু কর অব্যাহতি পায়, গ্রামীণ ব্যাংকেরও পাওয়া উচিৎ,” বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
জটিলতা কেন হয়েছিল?
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনে এনবিআর তিন বছর পরপর প্রজ্ঞাপন জারি করে আয়কর অব্যাহতির মেয়াদ নবায়ন করে আসছিল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে ছিলেন ড. ইউনূস। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর শুরু হয় জটিলতা।
২০১১ সালে বয়সের কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে ইউনূসকে সরিয়ে দেয় শেখ হাসিনার সরকার। তার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও বিফল হন ইউনূস। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই নয়, এর সহযোগী অন্য প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃত্ব হারাতে হয় ইউনূসকে।
গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়া হওয়ার পর একের পর এক মামলাও হতে থাকে ইউনূসের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মান্ডি লন্ডারিং, শ্রম আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতির অভিযোগে ১৬৮টি মামলার খবর পাওয়া যায়। একটি মামলায় তার সাজাও হয়েছিল এই বছরের শুরুতে। তবে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে সেই সাজা বাতিল করে আদালত।
মামলার পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রী ও দলের নেতারা ইউনূসকে কটাক্ষ করে একের পর এক মন্তব্য করে গেছেন গত দেড় দশকে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ আইনে পরিণত করার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত (বর্তমানে প্রয়াত) বলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘কর অবকাশ’ সুবিধা দেওয়া হতে পারে। তবে এই সুযোগ সব সময়ের জন্য নয়।
এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের কর অব্যাহতি সুবিধা বাড়াতে এনবিআরের গড়িমসি শুরু হয়। ২০১৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদন দীর্ঘদিন এনবিআরে পড়েছিল কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই।
সেবার গ্রামীণ ব্যাংক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য আয়কর অব্যাহতি সুবিধা চেয়েছিল। ছয় মাসেও এনবিআর কিছু না জানানোয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহিতকে চিিঠও দিয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক।
অনেক ঘুরিয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে গ্রামীণ ব্যাংকের আয়কর অব্যাহতি সুবিধা ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর আবার জটিলতায় পড়ে গ্রামীণ ব্যাংক। তাদের আবেদনে আর সাড়া দিচ্ছিল না সরকার।
প্রতিষ্ঠাতা এমডি এবার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন সেই মেয়াদ আগের মতো আবার বাড়ানো হলো।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “২০২০ সালে তাদের এসআরও এক্সপায়ার্ড করার পরে এটা আর নতুন করে হয় নাই। ওনারা এপ্লিকেশন করেছেন। আমরা আবার কর (কর অব্যাহিত দেব)।”
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করদিবসের মধ্যে রিটার্ন দাখিলসহ যাবতীয় নিয়ম পরিপালন করে তবেই এ সুবিধা পাবে গ্রামীণ ব্যাংক।
এদিকে এনবিআরের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে আহমাদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ‘আস–সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’ এ দান করা অর্থের ওপরও ২০২৯ সাল পর্যন্ত আয়কর অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে।