খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন একটি উপজেলা। অন্য সব উপজেলার মতো এখানেও রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। যেসব শাখার মাধ্যমে প্রতিদিন লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা।
সেখানে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। সেই শাখায় ঢোকার পথেই দোনলা একটি বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন নিরাপত্তাকর্মী।
সবেধন নীলমণি বন্দুকটি দেখিয়েই মূলত নিশ্চিত করা হয় ওই শাখার নিরাপত্তা, যেটির ভল্ট বা সিন্দুক সীমাই এক কোটি টাকার বেশি।
চট করে দেখে বোঝার উপায় নেই যে বন্দুকটি বিকল, না সচল। লেনদেন করতে আসা গ্রাহকদেরও আসলে খেয়াল করার সময় থাকে না, বন্দুকটি সচল না অচল।
সম্প্রতি বন্দুকটি নজরে আসে ওই শাখার এক গ্রাহকের। লেনদেন করতে গিয়ে তার চোখে পড়ে, বন্দুকটি জিআই তার দিয়ে প্যাঁচানো।
তার কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, বন্দুকটি আসলেই বিকল।
ভয় দেখানো ছাড়া বন্দুকটির আর কোনও কাজ নেই, তাই এনিয়ে ব্যাংকটির ওই শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেরা হাসাহাসিও করে।
ব্যাংকটির ওই শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুই দশক আগে কেনা হয়েছিল দোনলা বন্দুকটি। এটি দিয়ে এখন গুলি তো বের হয়ই না, বরং এটি যেন খুলে ছড়িয়ে না পড়ে, তাই বেঁধে রাখতে হয় জিআই তার দিয়ে।”
খবর নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকের ওই শাখার আওতায় পরিচালিত হয় ২০টির বেশি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট। এছাড়া এর আওতায় রয়েছে ১২টি এটিএম বুথ। ফলে এজেন্ট আউটলেট বা এটিএম বুথে নগদ টাকা আনা-নেওয়া করতে হয় নিয়মিত।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবহার করা হয় না কোনও সচল আগ্নেয়াস্ত্র।
নিরাপত্তার কারণে ব্যাংকটির নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না এই প্রতিবেদনে।
আগ্নেয়াস্ত্র নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক কোম্পানির কোনও শাখার সিন্দুক সীমা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা হলে সংশ্লিষ্ট শাখা দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাবে। প্রতিটি বন্দুকের জন্য সর্বোচ্চ ১০০টি গুলি কিনতে পারবে।
এক কোটি টাকার বেশি কিন্তু ৫ কোটি টাকার কম সিন্দুক সীমা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখা সর্বোচ্চ তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারবে। সিন্দুক সীমা ৫ কোটি টাকার বেশি হলে বন্দুক বা শটগান কেনা যায় সর্বোচ্চ চারটি।
অর্থ লেনদেনের সামর্থ্য অনুযায়ী, খুলনার ওই ব্যাংকটির শাখার সর্বোচ্চ তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সুযোগ রয়েছে।
তাহলে সচল একটি আগ্নেয়াস্ত্রও কেন নেই?
এবিষয়ে ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কেউই সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। প্রধান কার্যালয় থেকে এমন বিষয়ে কথা বলায় ‘নিষেধাজ্ঞা’ আছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বন্দুকের প্রসঙ্গে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ওই ব্যাংক শাখার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কর্তৃপক্ষ বিকল বন্দুক বিক্রি করে নতুন বন্দুক কেনার উদ্যোগ নিয়েছে, তবে প্রশাসনের অনুমতির অপেক্ষায় তা ঝুলে আছে।
ওই শাখার অনুকূলে থাকা একমাত্র আগ্নেয়াস্ত্রটির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালের অগাস্টে। এর ডিলার ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স খোরাম আলী অ্যান্ড সন্স। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ওই অস্ত্রটির যান্ত্রিক ত্রুটি সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় আগে ওই শাখা থেকে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নতুন একটি একনলা (শটগান) বন্দুক কেনার অনাপত্তি এবং পুরনো বন্দুক বিক্রির অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। এ সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার জন্য ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদনও নিয়েছিল শাখা কর্তৃপক্ষ।
তাছাড়া ভল্ট সীমা বেশি হওয়ায় আরও দুটি নতুন বন্দুক কেনার জন্য লাইসেন্সের আবেদন করেও দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় রয়েছে ব্যাংকটির ওই শাখা।
জেলা ম্যাজিট্রেটের কার্যালয়ে বার বার যোগাযোগ করেও কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান ব্যাংকের ওই শাখার এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, নতুন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের একটি অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও পাঠানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৪ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের কাছে এ সংক্রান্ত অনাপত্তি আবেদন করে চিঠি দেন খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ইয়াসির আরেফীন।
যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬ এর নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এই অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে।
ওই নীতিমালার ২৮ এর ‘খ’ ধারায় বলা হয়েছে, “লাইসেন্সে লিপিবদ্ধ করার ৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ত্রুটিপূর্ণ হলে তা বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে। এক্ষেত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্র মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্র এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সুপারিশের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে।
“লং ব্যারেল আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে আগের লাইসেন্স বাতিল সাপেক্ষে তৎপরিবর্তে নতুন লাইসেন্স দেওয়া যাবে।”
আগ্নেয়াস্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দোনলা বন্দুক বা শটগান লং ব্যারেল আগ্নেয়াস্ত্রের অন্তর্ভূক্ত। ফলে এটির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ইয়াসির আরেফীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা ভুলবশত হতে পারে। আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
“তবে গত বছর নির্বাচনের আগের বছর হওয়ায় অনেক ধরনের অস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ ছিল। এসব কারণে হয়ত ওই শাখার বন্দুকের ইস্যুটি সঠিকভাবে দেখা হয়নি।”