ভারত-শাসিত কাশ্মীরের একটি জনপ্রিয় পর্যটন উপত্যকায় মঙ্গলবার সন্দেহভাজন বন্দুকধারীদের গুলিতে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন। দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এটি বেসামরিক নাগরিকদের উপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা।
পুলিশের দুই কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, অন্তত দুজন বন্দুকধারী পহেলগাম শহর থেকে প্রায় ৫৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বৈসারণ উপত্যকায় পর্যটকদের উপর গুলি চালায়। এই উপত্যকা পাহাড়ঘেরা একটি নয়নাভিরাম সবুজ প্রান্তর। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ ভারতের প্রচণ্ড গরম থেকে মুক্তি পেতে হাজার হাজার ভারতীয় পর্যটক সেখানে যান।
ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের অধিকাংশই ভারতীয় পর্যটক। তারা পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম এই উপত্যকায় পৌঁছেছিলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত দুইজন বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। হামলার পরপরই বন্দুকধারীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সোশাল মিডিয়া এক্সে এক পোস্টে লেখেন, “এই হামলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসামরিক নাগরিকদের উপর যত হামলা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ।”
কাশ্মীর অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকাগুলোর একটি। অঞ্চলটি পুরোপুরি নিজেদের দাবি করে আসছে ভারত ও পাকিস্তান। যদিও তারা এর নির্দিষ্ট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুই পরাশক্তিধর প্রতিবেশী দেশ এ অঞ্চল নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে।
ঘটনার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরবে ছিলেন। ঘটনা শুনেই তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে মঙ্গলবার রাতেই দেশে ফিরছেন বলে পিটিআই জানিয়েছে। বিমানবন্দরে নেমেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
মোদী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, “এই জঘন্য ঘটনার নেপথ্যে যারা রয়েছে, তাদের শাস্তি হবেই… কাউকেই ছাড়া হবে না! তাদের এই অপকর্ম কোনোদিন সফল হবে না। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অটুট থাকবে এবং তা আরও শক্তিশালী হবে।”
হামলার পর কাশ্মীরে গেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কাশ্মীরের শ্রীনগরে গিয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই হামলাকে “অত্যন্ত নিন্দনীয় ও হৃদয়বিদারক” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে “অর্থহীন দাবি” করা হচ্ছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে।
রাহুল গান্ধী বলেন, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ একত্রিত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে—এ ধরনের অর্থহীন দাবি না করে সরকারের এখন দায়িত্ব নেওয়া উচিত এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা না ঘটে এবং নিরীহ ভারতীয়রা এভাবে প্রাণ না হারান।”
এদিকে “কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স” নামে একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া একটি বার্তায় এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, অঞ্চলে “বহিরাগত” হিসেবে চিহ্নিত ৮৫ হাজারের বেশি মানুষের বসতি স্থাপন নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ। গোষ্ঠীটি দাবি করেছে, এভাবে অঞ্চলটিতে “জনসংখ্যার কাঠামোতে পরিবর্তন” ঘটানো হচ্ছে।
হামলার পরবর্তী করুণ চিত্র স্থানীয় বাসিন্দারা সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। দুর্গম এই উপত্যকায় সড়কপথে যাতায়াত সম্ভব না হওয়ায়, আহতদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়।
যে পর্যটক দলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়, সেই দলে ছিলেন গুজরাট থেকে আসা একজন। তিনি বলেছেন, হঠাৎ হামলা শুরু হলে মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সবাই দৌড়াতে শুরু করেন এবং কান্না ও চিৎকার করতে থাকেন।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে বলে ওই অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা জানিয়েছেন। তারা হামলাকারীদের ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মীরের দুর্গম পাহাড়ি ও বনাঞ্চলভিত্তিক এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর জঙ্গি হামলা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
কাশ্মীরে গতকালের এই হামলা হয়েছে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের চার দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে। হামলার পর জেডি ভ্যান্স এক্সে লিখেছেন, “ভারতের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ভুক্তভোগীদের প্রতি উষা ও আমি সমবেদনা জানাচ্ছি। গত কয়েক দিন আমরা এই দেশের সৌন্দর্য ও এর জনগণের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। এই হামলায় শোকার্ত মানুষের প্রতি আমাদের প্রার্থনা রইল।”
ভয়াবহ এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও নিন্দা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এক ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বর্বর সন্ত্রাসী হামলার কঠোর নিন্দা জানান এবং হামলার দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে ভারতের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধীর জয়সওয়াল এক্সে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিরপরাধ প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে আছে।”
ট্রাম্প তার সোশাল মিডিয়া ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ আগেই একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লেখেন, “কাশ্মীর থেকে আসা এই খবর অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ভারতের অসাধারণ জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও গভীর সমবেদনা রইল। আমাদের হৃদয় আপনাদের সবার সঙ্গে আছে।”
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বার্তা পাঠিয়ে পাহেলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, “এই বর্বরোচিত অপরাধের কোনো বৈধতা নেই, এবং দায়ীরা তাদের প্রাপ্য শাস্তি পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হামলার শিকার হওয়া নাগরিকরা বিভিন্ন দেশের, যা এই ঘটনার ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে তোলে। তাদের পরিবার-পরিজনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।”
প্রেসিডেন্ট পুতিন আরও বলেন, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে রাশিয়ার সহযোগিতা আরও জোরদার করা হবে।”
হামলার ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সংযোগ নেই।”
তিনি দাবি করেন, এই হামলা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত, এমনকি মণিপুরের অস্থিরতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের প্রতিক্রিয়া। তিনি এটিকে “স্বদেশে উত্থিত” ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন।
আসিফ বলেন, “ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নাগাল্যান্ড, মণিপুর, কাশ্মীর ও ছত্তিশগড়সহ অনেক রাজ্যে বিক্ষোভের মুখোমুখি হচ্ছে। এটি স্বদেশে উত্থিত সমস্যা, কারণ সরকার জনগণের ওপর শোষণ চালাচ্ছে। আমরা কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করি না, এবং স্থানীয় জনগণকে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত নয়—এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।”
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “কিন্তু যদি স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো ভারত সরকারকে লক্ষ্য করে, তাহলে পাকিস্তানকে দায়ী করা সহজ হয়ে যায়।”
বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য স্থায়ীভাবে কাশ্মীরে মোতায়েন রয়েছেন। ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরের আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করেন।
কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সর্বশেষ বড় ধরনের হামলা হয় ২০২৪ সালের জুনে। সে সময় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসে বন্দুকধারীরা গুলি চালালে ৯ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হন। এর আগে ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৪৬ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন।
তথ্যসূত্র : এনডিটিভি, নিউজ১৮, দ্য হিন্দু।