বনেদী পরিবারে জন্ম নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উজ্জ্বল সাফল্য দেখিয়েও সহজ এক জীবন না কাটিয়ে যিনি জীবনকে করে তুলেছিলেন কঠিন সংগ্রামের, সেই রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো আর নেই।
সাম্যবাদী রাজনীতিক হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে যে লড়াই তিনি চালিয়েছিলেন, ওই ধারার রাজনীতিতে নীতির প্রশ্নেও তাকে একই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
ফলে তার ৮১ বছরের জীবন পাঠ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতিধারা তো বটেই, দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের পথরেখাও স্পষ্ট করে তোলে।
গত শতকের ৬২ এর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পর কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বের কাতারে ছিলেন রনো।
ষাটের দশকে বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভাজনের মধ্যে চীনপন্থাকেই নিজের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। চীনপন্থি দলে শীর্ষ নেতৃত্বেও ছিলেন।
তবে শেষ জীবনে রুশপন্থি বলে এক সময় পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিতে ফিরে যান তিনি, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রুশ-চীন বিভাজনের রেখা আর স্পষ্ট নেই।
সিপিবির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসাবেই শনিবার প্রথম প্রহরে ঢাকার পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জীবনের যবনিকাপাত হয়।
ওই হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, রনো শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভুগছিলেন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত পৌনে ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
রনোর একমাত্র সন্তান রানা সুলতানা বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে কয়েকদিন আগে দেশে ফেরেন।
রনোর একমাত্র ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনোও ছিলেন একাধারে রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক। তিনি কয়েক বছর আগে মারা যান।
রনোর সাবেক স্ত্রী হাজেরা সুলতানা ওয়ার্কার্স পার্টিতেই রয়েছেন। তিনি সংসদে নারী আসনের সদস্য হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রনোর লাশ আপাতত ঢাকার শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে থাকবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। পরে বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।
তার দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি থেকে জানানো হয়েছে, রনোকে শেষ বিদায় জানানো হবে সোমবার। সকাল ১০ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত লাশ থাকবে পল্টনে সিপিবি কার্যালয়ে, সেখান থেকে শোক শোভাযাত্রা যাবে শহীদ মিনারে। সেখানে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব চলবে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে হবে জানাজা।
রনোর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে। তার নানা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক সৈয়দ নওশের আলী। তার আদি বাড়ি ছিল নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রাম।
নওশের আলীর মেয়ে কানিজ ফাতেমা মোহসিনা এবং প্রকৌশলী হাতেম আলী খানের বড় ছেলে রনো। হাতেম আলীর বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলায় চিত্রা নদীর পাড়ের গ্রাম বরশালায়।
রনো ১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পূর্ব পাকিস্তানে মেধা তালিকায় তিনি দ্বাদশ স্থান পেয়েছিলেন। নটরডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন তিনি।
তবে ততদিনে রাজনীতিকে নিজের জীবনের পাথেয় করে নিয়েছেন রনো। কারাবাসের কারণে স্নাতক ডিগ্রি নিতে পারেননি। কারাগারে থেকে পরীক্ষা দিয়ে এলএলবি ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিন্তু আইন পেশায়ও যাননি। রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখি এতেই জড়িয়ে রাখেন নিজেকে।
রনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বের কাতারে উঠে আসেন তিনি, ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচত হন।
ছাত্রজীবন শেষ করে শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে টঙ্গী বস্তিতে আবাস গাঁড়েন রনো। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তার আগে রুশ-চীন দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন ধরলে রনো চীনপন্থি অংশের নেতৃত্ব নেন।
তবে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। ১৯৭১ সালে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরি হয়েছিল। এসব অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭১ এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় বামপন্থিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। রনো ওই কমিটির ঘোষাণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর রনো ও তার সহকর্মীরা মিলে ১৯৭৩ সালে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে দলের নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। প্রথম থেকেই তিনি এই পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।
২০০৯ সালে রনো ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে পুরনো দল সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে দলটির সভাপতিমণ্ডরীর সদস্য হন তিনি। সর্বশেষ ছিলেন উপদেষ্টামণ্ডলীতে।
রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকার রাখার পাশাপাশি লেখালেখিও নিয়মিত চালিয়ে গেছেন রনো। সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। লিখেছেন ২৫টি বই।
২৪ বছর বয়সে তার লেখা ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’ বইটি ছিল পাকিস্তান আমলে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ।
তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম।
২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন রনো।