চাপের মুখে পদত্যাগে রাজি হয়েছেন হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি। গায়ানার প্রেসিডেন্ট এবং ক্যারিবিয়ান কমিউনিটির (ক্যারিকম) বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইরফান আলী এই খবর দিয়েছেন।
হাইতির রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ নিয়ে সোমবার জ্যামাইকার কিংস্টনে আঞ্চলিক নেতাদের এক বৈঠক হয়। যুক্তরাষ্ট্রও ওই বৈঠকে অংশ নেয়। তারপরই এরিয়েল হেনরির পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত এল। তবে হেনরি ওই বৈঠকে ছিলেন না।
হেনরি বর্তমানে পুয়ের্তো রিকোয় আটকা পড়েছেন। হাইতির সশস্ত্র গ্যাংগুলো তাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। ২০২১ সালের জুলাইয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইসের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ৭৪ বছর বয়সী হেনরি দেশটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
দেশের সহিংসতা মোকাবেলায় সহায়তার জন্য হেনরি ফেব্রুয়ারির শেষদিকে কেনিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে গিয়েছিলেন।
এদিকে ২৯ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র গ্যাংগুলোর একটি জোট হাইতির কয়েকটি পুলিশ স্টেশনসহ হাইতির বৃহত্তম দুটি কারাগার হামলা করে। তারা হাইতির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও হামলা চালায়।
গত ৫ মার্চ হেনরি দেশে ফিরতে গেলেও তাকে বহনকারী বিমানটি আর দেশের মাটিতে অবতরণ করতে পারেনি। এরপর হেনরিকে বহনকারী বিমানটি পুয়ের্তো রিকোয় যায়। হেনরি কেনিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে পাশের দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকও হেনরিকে তাদের আকাশপথ ব্যবহার করে হাইতিতে ঢুকতে বাধা দেয়।
কিংস্টনে বৈঠকের পর বক্তৃতাকালে ক্যারিকম চেয়ারম্যান ইরফান আলী বলেন, “আমরা তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। শিগগিরই দেশটির জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট পরিষদ গঠন করা হবে এবং অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হবে।”
অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরির পদত্যাগের দাবিতে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হাইতির রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের রাস্তায় নেমে এসেছে ভারী অস্ত্রধারী দলগুলো।
পোর্ট-আ-প্রিন্স ও আশপাশের অঞ্চল মাসব্যাপী জরুরি অবস্থায় রয়েছে। কারফিউর মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ তাদের রাষ্ট্রদূত ও কুটনীতিকদের দেশটি থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
হেনরির পদত্যাগ প্রত্যাশিত ছিল। ক্যারিকম তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল এই বলে যে, হেনরিকে হাইতির স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাকে সরে দাঁড়াতে হবে, যাতে দেশটির রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে একটি ক্রান্তিকালীন কাউন্সিলের কার্যক্রম শুরু করা যায়।
জিমি ‘বারবিকিউ’ চেরিজিয়েরের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র গ্যাংগুলোর জোটও হেনরি পদত্যাগ না করলে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল হেনরি সংকট উত্তরণকালীন প্রক্রিয়া তত্ত্বাধানে হাইতিতে ফিরে যাক। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দেশটিতে সহিংসতার তীব্রতায় ওয়াশিংটন মত বদলায়।
যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রতিবেশীদের সমর্থন ছাড়া এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হেনরির পদত্যাগ করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।
বহুজাতিক শান্তিবাহিনী
২০১০ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর থেকে হাইতিতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে। সংঘবদ্ধ সশস্ত্র দলগুলোর হাতে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশটির মানুষ। ২০১৬ সালের পর দেশটিতে আর কোনও নির্বাচন হয়নি। ২০২০ সাল থেকে সশস্ত্র গ্যাংগুলোর মধ্যে শুরু হয় সংঘাত। ২০২১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়।
অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এক বছর আগে দেশটির সরকার রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে একটি বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছিল। সশস্ত্র গ্যাংগুলো রাজধানীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হেনরি ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো হাইতিতে দ্রুত একটি বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানান। তার উদ্দেশ্য ছিল দেশটির পুলিশকে শক্তিশালী সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করা। সন্ত্রাসীরা দ্রুত তাদের প্রভাব ও সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছিল। ফলে পোর্ট-অব-প্রিন্সে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দেয়।
এক বছর পর ২০২৩ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব পাস করে হাইতিতে একটি বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনের অনুমোদন দিয়ে কাঠামো নির্ধারণ করে। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, মিশনটি জাতিসংঘের নেতৃত্বে পরিচালিত না হলেও তত্ত্বাবধানে ভূমিকা রাখবে। এই লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠন করা হবে। এতে সহায়তা দানে আগ্রহী দেশগুলোর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি নেওয়া হবে।
বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনে দেশগুলো খুব একটা সাড়া দিচ্ছে না। অনেকেই হেনরির সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ দেশটিতে এই সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। আর দেশটিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে অনেকেই সতর্ক।
বিশেষ করে হাইতি ও বিদেশে অবস্থানরত হাইতির অনেক নাগরিক বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েনের বিরুদ্ধে। কারণ এর আগের জাতিসংঘ মিশনগুলোর পরে দেশটিতে ভয়াবহ কলেরা মহামারি ও মিশনের সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর জন্য কখনোই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।
গত বছর কেনিয়া এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু হাইতির আদালত জানায়, এর জন্য হাইতির পক্ষ থেকে একটি পারস্পরিক চুক্তির প্রয়োজন। এই চুক্তি স্বাক্ষর করতেই প্রধানমন্ত্রী হেনরি তার দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যেও গত মাসের শেষদিকে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে যান। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত মঙ্গলবার তিনি হাইতিতে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেশে ফিরতে না পেরে পুয়ের্তো রিকোতে আশ্রয় নেন।
জাতিসংঘ গত মাসে জানায়, পাঁচটি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওই বাহিনীতে সৈন্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক সেনা পাঠানোর কথা বলেছে বেনিন, এই সংখ্যা দেড় হাজার। সাদ, বাংলাদেশ ও বার্বাডোসও আনুষ্ঠানিকভাবে সৈন্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া বাহামাস আগে জানিয়েছিল যে তারা ১৫০ কর্মী পাঠাবে।
কেনিয়া ১ হাজার পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে কেনিয়ার সংসদ সদস্যরা বুরুন্ডি ও সেনেগাল থেকেও সহায়তা পাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানায়।
এদিকে মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজের একটি সংবাদমাধ্যম জানায়, তাদের দেশও হাইতিতে ৫০ জন সেনা পাঠাবে। এর বাইরে অ্যান্টিগা, বার্মুদা ও সুরিনামও সেনা ও কর্মী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
কিছু দেশ হাইতিকে সমর্থনের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পেন ও জ্যামাইকা। মঙ্গোলিয়া, গুয়াতেমালা, ইতালি ও পেরুও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এল সালভাদর জানিয়েছে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে।
তবে প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিক স্পষ্ট করে বলেছে, তারা বহুজাতিক বাহিনীতে অংশ নেবে না। দেশটির প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তাদের ভূখণ্ডে হাইতিয়ান শরণার্থী শিবির স্থাপন করতে দেওয়া হবে না। হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক একই দ্বীপের দুটি দেশ।
জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই বাহিনী মোতায়েনে রাষ্ট্রগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানাতে হবে। এই প্রক্রিয়ার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
২০০৪-১৭ সালে হাইতিতে জাতিসংঘের মিনুস্তাহ মিশন ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। এই মিশনের জন্য প্রাথমিকভাবে ৬ হাজার ৭০০ সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
এবার জাতিসংঘ হাইতিতে ‘মাল্টিন্যাশনাল সিকিউরিটি সাপোর্ট মিশন’ নামে একটি নতুন নিরাপত্তা মিশন অনুমোদন করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো – সম্ভাব্য গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নেওয়া, মানবিক সহায়তার জন্য রুট নিরাপদ করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ও হাইতির পুলিশকে সহায়তা করা।
তবে এই মিশন কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আগের মিশনের মতো এটিরও ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য এই মিশনের সাফল্য-ব্যর্থতা এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।
হাইতির জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল
ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষকরা বলেছেন, কেনিয়ার মূল্যায়ন অনুসারে এই মিশনের জন্য ৫ হাজার সেনা-কর্মী এবং বছরে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এই বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশ। তারা ২০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশটি আরও জানায়, গায়ানাও অর্থায়ন করবে, তবে কতটা তা স্পষ্ট নয়।
সোমবার জ্যামাইকার কিংস্টনের বৈঠকের অংশগ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইতিতে বহুজাতিক শান্তিবাহিনীর জন্য আরও ১০০ মিলিয়ন ডলার আর মানবিক সহায়তা হিসেবে ৩০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
কানাডা প্রায় ৫৯ ও ফ্রান্স ৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। এছাড়াও ফ্রান্স মিশনের জন্য ফরাসি ও ক্রিওল ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য আরও ৯ লাখ ২৪ হাজার ডলার দেবে।
জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র জানান, গত ৫ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৭৮ মিলিয়ন ডলার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কানাডা ও ফ্রান্স থেকে তহবিলে ১১ মিলিয়ন ডলারেরও কম জমা পড়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর থেকে কোনও পক্ষই আর তহবিলে অর্থ জমা দেয়নি।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার আরও দেশকে, বিশেষ করে ফরাসি-ভাষী দেশগুলোকে তহবিল দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
হাইতি দীর্ঘ ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কারণ হাইতিয়ান বিপ্লবের সময় দেশটিতে থাকা ওই দেশ দুইটির সম্পত্তি (এর মধ্যে দাসও ছিল) নষ্ট হয়েছিল।
হাইতির ঋণের বোঝা অনেক ভারী ছিল। ঋণ পরিশোধের জন্য দেশটিকে পুনরায় ঋণ নিতে হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানে বের হয়, এই ঋণের বোঝার কারণে হাইতির উন্নয়ন ব্যাহত হয়। দেশটির ক্ষতি হয় কয়েক বিলিয়ন ডলার। হাইতি বর্তমানে পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ।
হাইতির দুর্দশার ঐতিহাসিক পটভূমি
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝামাঝি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দেশ হাইতি। দেশটি যে দ্বীপে অবস্থিত সেটি একটি একটি বড় দ্বীপ। দ্বীপের এক অংশে হাইতি আর অপর অংশে ডমিনিকান রিপাবলিক। ১৪৯২ সালে ইউরোপীয়দের আগমনের পর দেশটি প্রথমে স্পেনের এবং পরে ফ্রান্সের উপনিবেশ হয়েছিল। এর প্রাচীন বাসিন্দাদের বলা হতো তাইনো ও আরাওয়াকান। পরে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে কালো মানুষদের দাস হিসেবে ধরে এনে সেখানে নীল, তুলা ও আখের চাষ করাতো।
আমেরিকা মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পর হাইতি ছিল দ্বিতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবের মাত্র ১৫ বছর এবং ফরাসি বিপ্লবের দুই বছর পর ১৭৯১ সালে হাইতির দাসরাও বিদ্রোহ করে, যা ইতিহাসে হাইতিয়ান বিপ্লব নামে পরিচিত। ১৮০২ সালে হাইতি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ফরাসি সম্রাট নোপোলিয়ান হাইতিতে সেনা পাঠান। দুই বছর যুদ্ধ করেও হাইতিয়ানদের দমাতে না পেরে নেপোলিয়ান সেনা প্রত্যাহার করেন। ১৮০৪ সালে পুনরায় হাইতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই গৃহযুদ্ধে দেশটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। এরপর ১৮২৫ সালে কুটনৈতিক স্বীকৃতির বিনিময়ে ফ্রান্সকে ১৫০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক ক্ষতিপুরণ দেওয়ার চুক্তি করায় দেশটির অর্থনীতি আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। প্রথম কিস্তিতে হাইতি ফ্রান্সকে যে পরিমাণ অর্থ দেয় তা দেশটির মোট জিডিপির ছয়গুন ছিলো। ১৯৩৮ সালে ফ্রান্স ক্ষতিপুরণের অংক কমিয়ে ৯০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্কে নামিয়ে আনে, যা বর্তমান কালের প্রায় ৩ হাজার ২৬০ কোটি ডলারের সমান। ১৮২৫ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে হাইতি ফ্রান্সকে মোট ১১২ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক ক্ষতিরপুরণ দেয়।
ফ্রান্সের অবাস্তব দাবির কারণে হাইতি ফরাসী ব্যাংক ক্রেডিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এট কমার্শিয়াল থেকে বড় ঋণ নিতে বাধ্য হয়, যা ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডারদের সমৃদ্ধ করে। ফ্রান্স ১৮৮৮ সালে হাইতির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের শেষ কিস্তি পেয়েছিল। দারিদ্রর কারণে হাইতি আর ফ্রান্সকে টাকা দিতে পারছিলো না। তবে এরপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯১১ সালে হাইতির কোষাগার অধিগ্রহণের জন্য অর্থায়ন করে, যাতে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত সুদ পরিশোধ করা যায়। ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র হাইতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
১৯১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র হাইতির শাসনভারও নিজের হাতে তুলে নেয়, ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত হাইতি কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিল। ১৯২২ সালে ফ্রান্সের কাছে হাইতির বাকি ঋণ আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের প্রদানের জন্য স্থানান্তরিত হয়। এরপর থেকে নিউইয়র্কের ন্যাশনাল সিটি ব্যাংক (বর্তমানে সিটিব্যাঙ্ক) এর কাছে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত হাইতির প্রায় ১২২ বছর সময় লেগেছিল ফ্রান্সের ক্ষতিপূরণের সমস্ত অর্থ পরিশোধ করতে। ২০১৬ সালে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট চার্লস এক্স-এর ১৮২৫ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করে, তবে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে হাইতিকে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।
ফ্রান্সকে এই ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়েই হাইতি আর দারিদ্র্য মুক্তি পায়নি বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। তবে অনেক ইতিহাসবিদ ঋণ পরিশোধ শেষ হওয়ার পরও প্রতিবেশী ডোমিনিকান রিপাবলিকের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে হাইতির নিজের ব্যর্থতাকেই দেশটির দারিদ্র্যের জন্য দায়ী বলে মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশটি নতুন সংবিধান রচনা করে। তবে এতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগকে একচেটিয়া বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর ফলে দেশটিতে অচিরেই স্বৈরাচারী শাসকের আবির্ভাব ঘটে এবং শাসকশ্রেণির মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দেয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হাইতির স্বৈরশাসক ফ্রঁসোয়া দুভালিয়ারের শাসনকালকে আধুনিক সময়ের অন্যতম নিপীড়নকারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তার শাসনামলেই হাইতিতে সশস্ত্র গ্যাংগুলো গড়ে উঠে। স্বৈরশাসক দুভালিয়ারের হাত ধরেই প্রথম সশস্ত্র গ্যাংটি গড়ে উঠে। বিরোধীদের দমনের জন্য টনটন ম্যাকাউট নামে একটি ব্যক্তিগত প্যারামিলিটারি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে ফ্রঁসোয়া দুভালিয়ারের মৃত্যুর পর ছেলে জ্যাঁ-ক্লদ দুভালিয়ার এর সময়ও হাইতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে। তার ভোগ-বিলাসী জীবন যাপন হাইতির দারিদ্র্যকে আরও গভীর করে তোলে। ১৯৮৫ সালে তার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর প্লেনে চড়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। এরপর তার বাবার গড়া সশস্ত্র প্যারামিলিটারি বাহিনী টনটন ম্যাকাউটকে ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও তারা অস্ত্র ছাড়েনি এবং একটি গ্যাং হিসেবে কাজ করতে থাকে।
এই সময়ে হাইতির অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীও সশস্ত্র গ্যাং গড়ে তুলতে থাকে। দেশটিতে শুরু হয় নৈরাজ্য। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট জ্যঁ-বেত্রোঁ অ্যারিস্তিদ দুভালিয়ার-পন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হাইতিয়ান সেনাবাহিনীকেও ভেঙে দেন। কিন্তু এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কেউই হাত থেকে অস্ত্র ছাড়েনি।
এবার সাবেক মিলিশিয়াদের পাশাপাশি সাবেক সেনা সদস্যরাও সশস্ত্র গ্যাং গড়ে তোলে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত, পোর্ট-আ-প্রিন্সে কার্যত অ্যারিসিটাইড-বিরোধী বিদ্রোহ চলতে থাকে। সাবেক সেনা সদস্যরাও সরকারকে আক্রমণ করে।
এই বিশৃঙ্খলার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮০-র দশক থেকেই দেশটির তরুণরাও একাধিক সশস্ত্র আত্মরক্ষা দল গঠন করে। এগুলোকে বলা হতো শিমেয়ার। অ্যারিস্তিদ সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন তাদেরকে নৈতিক সমর্থন এবং অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। অ্যারিস্তিদের ফ্যানমি লাভলাস পার্টির কাছ থেকে কার্যত রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়ে এই তরুণ সশস্ত্র গ্যাংগুলো পুরো হাইতি সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং তারা ক্রমশ স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠে। ফলে দেশটিতে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ২০০৪ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান অ্যারিস্তিদ।
২০০৪ সালেই এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আঘাত হানে হাইতিতে। এতে মারা যায় ৩ হাজার মানুষ, আর ঘরবাড়ি হারায় ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। বন্যায় ধ্বংস হয় ধানের মাঠ ও ফলের বাগান।
২০০৬ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হাইতিতে রেনে প্রেভালের নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। গরিব মানুষদের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১০ সালে ৭ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প দেশটিতে আঘাত হানে। এতে প্রায় ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। এই ভূমিকম্প মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয়।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসে মিশেল মার্তেলির সরকার। তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। তবে তার সময়ে ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া অবকাঠামোগুলো পুনরায় নির্মাণ শুরু হয়। আগের সরকারের প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি নতুন প্রকল্পও নেন তিনি। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে তার সরকারের বিরুদ্ধে প্রায়ই সহিংস বিক্ষোভ হতো।
তবে তার সময়ে ২০১০ সালের ভূমিকম্পে বাড়িঘর হারানোদের বেশিরভাগ তাদের বাড়িঘর ফিরে পান। তিনি হাইতিয়ান যুবকদের বৃহৎ অংশের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি হাইতিয়ান মা ও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আয় কর্মসূচির প্রস্তাব দেন। ২০১২ এবং ২০১৬ এর মধ্যে দেশটির পর্যটন শিল্পেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মিশেল মার্তেলি তার মেয়াদের শেষের দিকে হঠাৎ করেই পদত্যাগ করেন।
২০১৭ সালে হাইতির প্রেসিডেন্ট হন জোভেনেল মোইসে। কিন্তু তার সরকারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সাল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০১৯ সালেও বিক্ষোভ হয়। ২০১৯ সালে ফের ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রচুর প্রাণহানি এবং ২ লাখ পরিবার বাড়িঘর হারায়।
এরপর ২০২১ সালে তার সরকারের বিরুদ্ধে বড় আকারের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা তার পদত্যাগ দাবি করে। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।
২০২১ সালে ৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট মোইসকে হত্যা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হন। আর প্রেসিডেন্ট হন এরিয়েল হেনরি। হাইতির এই রাজনৈতিক অস্থিরতার নেপথ্যে মূলত দেশটির সশস্ত্র গ্যাংগুলোই দায়ী। সশস্ত্র গ্যাংগুলো একেক সময় এক রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনে আবার ছুড়ে ফেলে।
২০২১ সালে আগস্টে হাইতিতে ফের ৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে প্রায় ১৪১৯ জন মারা যায়। এরপর ২০২২ সাল থেকে হাইতিতে সশস্ত্র গ্যাংগুলোর তীব্র সংঘাত শুরু হয়। দেশটিতে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য।
২০২২ সালের ১১ অক্টোবর হেনরি ও তার মন্ত্রিসভা পোর্ট-আ-প্রিন্সে গ্যাং ও সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমনের জন্য বিদেশি সৈন্য মোতায়েনের অনুরোধ করে। ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা হাইতিয সরকারকে সাহায্য করার জন্য সাঁজোয়া যান এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়।
গত ২ মার্চ সশস্ত্র গ্যাংগুলো হাইতির দুটি বড় কারাগারে হামলা করে অপরাধীদের মুক্ত করে দেয়। এসময় প্রধানমন্ত্রী হেনরি একটি বহুজাতিক শান্তি বাহিনীর চুক্তি চূড়ান্ত করার কেনিয়ায় ছিলেন।
এরপর ৪ মার্চ সশস্ত্র গ্যাংগুলো রাজধানীর সুরক্ষিত তুসেন্ত ল্যুভারচার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা করে সেটি দখল করে নেয়। এতে এরিয়েল হেনরি আর দেশে ফিরতে পারেননি।
গুজব ছড়িয়েছে হাইতির পুরো অভিজাত শাসক শ্রেণিকেই উৎখাত করার জন্য নাকি এবার দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংগুলোর মধ্যে একটি জোট তৈরি হচ্ছে। সশস্ত্র গ্যাংগুলো এবার সারাসরি নিজেদের হাতেই দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন, কনসার্ন ইএসএ ডট ওআরজি