হজের খরচ কমানোর দাবি উঠায় তা নিয়ে কাজ করছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। তবে প্যাকেজের খরচ কত হবে তা এখনও জানাতে পারেননি ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
এ পরিস্থিতিতে হজে যেতে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে নিবন্ধন চূড়ান্ত করার কথা বলা হলেও সেই আহ্বানে খুব একটা সাড়া মেলেনি।
তবে আগ্রহীরা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে প্রাক নিবন্ধন করে রেখেছেন। তিন লাখ টাকা জমা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধন করতে সাড়া দিচ্ছেন না।
২০২৫ সালের হজে যেতে বাংলাদেশের জন্য ১ লাখ ২৭ হাজার জনের কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে সৌদি সরকার। তবে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ৪ হাজার ৭৬৯ জন। আর প্রাক নিবন্ধন করেছেন সরকারি-বেসরকারি মিলে সাড়ে ৬৪ হাজার জন। কোটার বিপরীতে সাড়া মিলছে খুবই কম।
আগামী বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি হজের ভিসা প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর হজ ফ্লাইট শুরু হবে মে মাসে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় এখনও হজ প্যাকেজের চূড়ান্ত খরচ নির্ধারণ করেনি। আশা করা যাচ্ছে, অক্টোবর মাস শেষে সেটি চূড়ান্ত করেই ঘোষণা দেওয়া হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হজের খরচ কমানোর দাবি ওঠে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। খরচ কমাতে তিনি বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর তিনি সৌদি আরব গিয়ে দেশটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। কিন্তু এখনও প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়নি।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (হাব), চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “খরচ কত হবে সেটিই তো এখনেও চূড়ান্ত হয়নি। তাহলে নিবন্ধনে সাড়া মিলবে কীভাবে।
“এখন যারা নিবন্ধন করেছেন, তারা হচ্ছেন ‘খরচ যতই হোক না কেন, এবার হজে যাবেন নিশ্চিত’ —এমন মানুষ। এর বাইরে বিশাল সংখ্যক মুসলিম হজে যেতে আগ্রহী, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে খরচ কতটা কমবে তার ওপর। ফলে সেটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সাড়া মিলবে বলে আমার মনে হয় না।”
২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রীর কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল সৌদি সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হজে যান ৮৫ হাজার ২২৫ জন; শতাংশের হিসাবে ছিল ৬৭ শতাংশ। বাকি ৩৩ শতাংশ কোটার হজযাত্রী যেতে পারেনি খরচ বেশি থাকার কারণে।
২০২৪ সালে একজন হজযাত্রীকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা প্যাকেজে হজে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালে এই খরচ ছিল যাত্রীপ্রতি সর্বনিম্ন ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা; যা রেকর্ড। ফলে গত দুই বছরই হজে যেতে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি। হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ওমরাহ যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এই পরিস্থিতিতে গত বছর হজের খরচ কমাতে জোর দাবি ওঠে। সেই দাবির প্রেক্ষিতে বিষয়টি সমাধানে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হজের খরচ কমানোর দাবি আবারও উঠেছে।
এবার সর্বনিম্ন হজ প্যাকেজ চার লাখ টাকা করার দাবি করে গত ৪ সেপ্টেম্বর ধর্ম উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছিলেন জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী।
সেই চিঠিতে একটি নমুনা দেওয়া হয়েছে। যাতে বলা আছে, একজন হজযাত্রীর ন্যূনতম খরচ এমন হতে পারে- সৌদি আরব কর্তৃক নির্ধারিত মুয়াল্লিম ফি ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বিমান ভাড়া ১ লাখ টাকা। বাসা ভাড়া, খাবার ইত্যাদি বাবদ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সর্বমোট খরচ ৪ লাখ টাকা।
মোহাম্মদ আলীর পরামর্শ, হাজযাত্রীদের পরিবহনে থার্ড একটি এয়ারলাইনকে সুযোগ দিলে প্যাকেজের সময় কমে আসবে। ফলে বাসা ভাড়া ও খাবারের খরচও কমে আসবে।
সেসব পরামর্শ আমলে নিয়ে কাজ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে বড় খরচ হচ্ছে বিমান ভাড়া।
২০২৪ সালে বিমান ভাড়া ছিল ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এবার সেটি কমিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে খরচ কমতে পারে মাত্র ২০ হাজার টাকা। বিমান বাংলাদেশ কিংবা ধর্ম মন্ত্রণালয় কেউই এ বিষয়ে মুখ খোলেননি।
গালফ ট্রাভেলসের কর্ণধার শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিদ্যমান অবস্থায় সরকার আন্তরিক হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা কমানো সম্ভব। ভাড়া যেহেতু বাংলাদেশ বিমান নির্ধারণ করে থাকে, তাই বাংলাদেশ চাইলে সেটি কার্যকর করতে পারে।
“আরও ভাড়া কমানোর জন্য বর্তমানে থাকা বিমান বাংলাদেশ, সাউদিয়া এয়ারলাইনস ও ফ্লাইনাস—এই তিনটি বিমান সংস্থার বাইরে তৃতীয় বিমান সংস্থাকে সুযোগ দিতে পারে কিংবা সবাইকে উম্মুক্ত করে দিতে পারে। তখন প্রতিযোগিতা দিয়ে ভাড়া কমানোর সুযোগ আসবে। সেটি করা গেলে ভাড়া ৬০-৭০ হাজার টাকার বেশি কমবে। ফলে হজের প্যাকেজ খরচ এক লাফেই খরচ ৫ লাখের কাছাকাছি চলে আসবে।”
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সোয়া পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে হজের সর্বনিম্ন খরচ দিয়ে একটি প্যাকেজ ঘোষণা হতে পারে। সেটি চূড়ান্ত করার জন্য সৌদি সরকারের সর্বশেষ খরচের তালিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে মন্ত্রণালয়।
ধর্ম সচিব মু আ হামিদ জমাদ্দার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হজের খরচ কমানোর পুরো বিষয়টা সৌদি আরব সরকারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ অংশে খরচ কমানোর সুযোগ আছে, তবে সেটি অনেক কম। এরপরও আমরা আশা করছি, খরচ কমবে। সেটি কত তা, এখনই বলা যাবে না।”
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “এ বছর হজের দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। একটি প্যাকেজ হবে মসজিদুল হারামের আশপাশের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে বাড়িসহ একটি। এই প্যাকেজের মূল্য একটু বেশি হতে পারে।
“আরেকটি হবে ‘আজিজিয়া প্যাকেজ’; যেটির খরচ হবে সর্বনিম্ন। এই প্যাকেজ মক্কা থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে আজিজিয়ায় হাজিদের রাখা হবে। সেখান থেকে মসজিদুল হারামে যাতায়াতের জন্য বাস বা যানবাহন থাকবে।”
তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীরা আজিজিয়ায় যেতে খুব একটা আগ্রহী নন বলে জানান হজ এজেন্সির কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সবসময় মসজিদুল হারামের কাছাকাছি হাঁটা দূরত্বেই থাকতে পছন্দ করেন বাংলাদেশিরা।
ধর্ম মন্ত্রণালয় এক মাস আগে এক নির্দেশনায় বলেছিল, ২৩ অক্টোবরের মধ্যে হজযাত্রী নিবন্ধন শেষ না হলে মিনা ও আরাফায় কাঙ্ক্ষিত এলাকায় তাঁবু বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। তাঁবু গ্রহণ ও সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে দেরি হলে হজযাত্রীদের জামারাহ হতে অনেক দূরে পাহাড়ী এলাকা কিংবা নিউ মিনা এলাকায় অবস্থান করতে হবে। ফলে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে প্রখর রোদ ও গরমের মধ্যে দীর্ঘপথ হাটতে হবে, যা হজযাত্রীদের জন্য কষ্টকর হবে। সে কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়।
কিন্তু হজ এজেন্সিগুলো বলছে, বাংলাদেশ মনে হয় এটাই প্রথম হজ প্যাকেজ ঘোষণার আগে নিবন্ধনের সময় বেঁধে দিল। এটা বিস্ময়কর ঘটনা।
হজ এজেন্সি বিসমিল্লাহ ওভারসিজ অ্যান্ড হজ সার্ভিসের কর্ণধার মোহাম্মদ আবুল আনোয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ, একজন হজ যাত্রীর একটা বাজেট আছে। পরিবারের কত সদস্য হজে যাবেন সেটি নির্ভর করছে সেই বাজেটের ওপর। ফলে প্যাকেজ না জানলে তিনি কখনোই প্রাথমিক নিবন্ধন করবেন না।
“প্রাথমিক যারা নিবন্ধন করেছেন তারা হজে যাবেন একেবারে চূড়ান্ত। কারণ, নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া তিন লাখ টাকা তারা ফেরত পাবেন না। আর প্রাক-নিবন্ধন যারা করেছেন, তাদের কত অংশ শেষ পর্যন্ত হজে যাবেন সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। কারণ, ৩০ হাজার টাকা দিয়ে প্রাক-নিবন্ধন করলে সেটি বাতিল করলে ২৯ হাজার টাকার মতো তারা ফেরত পাবেন। ফলে প্রাথমিক নিবন্ধন কত হলো, সেটি দিয়ে হজের লক্ষ্যমাত্রা কত পূরণ হবে কখনোই আঁচ করা যাবে না।”